ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ ভাদ্র ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

সফল নারী উদ্যোক্তা ফাতেহা


প্রকাশ: ২৩ মার্চ, ২০১৯ ১৫:০১ অপরাহ্ন


সফল নারী উদ্যোক্তা ফাতেহা

   

মেহেদী হাসান খাজা : একটা সময় আমাদের সমাজে এমন ধারণা ছিল যে, নারীরা শুধু ঘরের কাজই করবে। রান্নাকরা, ঘর গোছানো, ছেলে-মেয়ে লালন-পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তাদের জগৎ। নারীরা এক সময় উৎপাদনশীল অর্থনীতির মূলধরায় সরাসরি সম্পৃক্ত হবেন-এটা অনেকে কল্পনাও করতে পারতেন না। তারা ভাবতেই পারতেন না যে, একটি নারী জীবনে অনেক কিছুই করতে পারে।

কিন্তু এই নারীরাও পারে তাদের দক্ষতা দিয়ে একজন পুরুষের মত জীবন সাজাতে। পুরুষদের ধারণা ছিল নারীরা বাইরে কাজ করতে পারবে না, তাদের ঘরের কাজই সামলাতে হবে। তাছাড়া অনেক পুরুষই তাদেরকে গোলাম বানিয়ে রাখতে চায়। এমন সব ভ্রান্ত ধারণা যারা মনের মধ্যে পুষে রেখেছিলেন গত দুই দশকে তাদের সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছেন লক্ষ-লক্ষ সাহসী নারী।

সবক্ষেত্রে নারীরা যে এগিয়ে- সেটা এখন খুবই দৃশ্যমান। সর্বোচ্চ আদালত, প্রসাশন, সশস্ত্র বাহিনী, নারীসেনা (প্যারাট্রুপার), ট্রেনচালক, ওসি, ডিসি, ইউএনও, সংসদ সদস্য- সবক্ষেত্রে নারীদের এখন জয়জয়কার। প্রায় ২৮ বছর ধরে যে দেশের সরকার প্রধানের দায়িত্বে নারী, সেই দেশের নারীরা কী করে অর্থনীতির প্রাণশক্তি ব্যবসায় পিছিয়ে থাকবেন? তাই তো সংসারের পাশাপাশি নারীদের একটি বড় অংশ নিজ হাতে সামলাচ্ছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার সফল নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। চাকরির জন্য অপেক্ষা না করে ছোট মূলধন নিয়েই শুরু করেছেন ব্যবসা। যোগ্যতা আর মেধা দিয়ে সেই ছোট মূলধন আজ রূপ নিয়েছে বড় পুঁজিতে। নিজেদের পাশাপাশি অসংখ্য বেকারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন তারা।

নারী উদ্যোক্তা ‘‘উরসী মাহফিলা ফাতেহা’’। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৩ সালে এস.এস.সি পাশ করেন। এরপর সরকারি নিউ গভ: ডিগ্রী কলেজ থেকে ২০০৫ সালে এইচ.এস.সি পাশ করেন। ২০০৫-০৬ সালে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। ছোট বেলা থেকে আঁকা-আকিঁর সাথে জড়িত ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিষয়ে পড়ার সুযোগ থাকার পরেও ফাতেহা চারুকলায় ভর্তি হন। এরপর থেকে শুরু হয় পড়াশুনার পাশাপাশি কর্ম জীবন। এই উদ্যোক্তার পথচলা শুরু ২০০৬ সালে। পরিবার থেকে মাত্র ২০০০ টাকা নিয়ে তার মায়ের সহযোগিতায় সে একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন। তিনি তখন থেকেই  চিন্তা করেছেন নিজে কিছু করবেন সাথে সমাজের গ্রামীন নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সহযোগীতা করবেন। সেই চিন্তা থেকেই হস্ত শিল্পের কাজ শুরু করেন।

শুরু করেন জীবনের নতুন যুদ্ধ। প্রথমে হ্যান্ডপিন্টের শাড়ি তৈরি করেন। এরপরে তা নিজেদের মধ্যে বিক্রয় করেন। প্রথম দিকে নিজেই শাড়ির কাজ করতেন। পরবর্তীতে একজন নারী কর্মী সঙ্গী হিসেবে নেন। তার এ কাজে চোখ পড়ে একজন গামের্ন্ট ব্যাসায়ীর নজরে। এজন্য তিনি প্রথম ১ (এক) লক্ষ টাকার অর্ডার পান ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেট থেকে। এ থেকে উরসী মাহফিলা ফাতেহাকে উদ্যোক্তা হতে আরো সাহস যোগায়। প্রথম থেকেই উদ্যোক্তা সাহস না হারিয়ে অদম্য ইচ্ছা নিয়ে এগিয়ে চলেন। ১ লক্ষ টাকার অর্ডার পাওয়ার পর গ্রামে কর্মী খুঁজতে শুরু করেন। কিছু কর্মী পেয়েও যান। ঋণ করে কাজ শুরু করেন। সময় মত কাজ সম্পন্ন করে যখন ডেলিভারী দিতে গেলেন তখন আরেক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। দোকানের মালিক পণ্য নিতে অস্বীকার করেন। সাময়িক মন ভেঙ্গে যায় উদ্দ্যোক্তার। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েন নি।

এরপর ফাতেহা রাজশাহীতে ফিরে আসেন নতুন উদ্যমে শুরু করেন কাজ। চলতে থাকে পড়াশুনার পাশাপাশি কাজ। কর্ম জীবনের প্রথম বড় অর্ডারের লস দিয়েই শুরু করেন নতুন উদ্যগ। পারিবারিক ভাবে আসে বাধা। এর মধ্যে আবার ঢাকা থেকেই বৈশাখের ৪০০ পিস শাড়ির অর্ডার পান হ্যান্ডপ্রিন্টের। যেটা কর্মী দিয়ে করানো সম্ভব নয়, নিজেকেই করতে হবে। লেগে পড়েন উদ্যোক্তা, কাজ শেষে লাভ হয় ১০ হাজার টাকা। শুরু হয় নতুন দিগন্তের, আশার আলো জাগতে শুরু করে। এরপর তিনি চিন্তা করেন প্রতিষ্ঠানটির নাম করনের। কারণ প্রতিটি বিষয়ই একটি নিয়মের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল ভাবে করাই ভালো। এতে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌছানো সম্ভব। তখন “শীজ’’ নামকরনের মধ্য দিয়ে কর্ম পরিচালনা শুরু করেন। দিনে দিনে কাজের পরিধি বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অর্ডার আসতে শুরু করে। এমতা অবস্থায় উদ্যোক্তা চিন্তা করেন কর্মীদের দক্ষতা নিয়ে। সেই চিন্তার ধারাবাহিকতায় উদ্যোক্তা গ্রামীন তৃণমূল নারীদের সংগঠিত করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি করে সাবলম্বী হতে সহযোগীতা করেন। প্রায় ১৩ বছর যাবত ফাতেহা প্রান্তিক নারীদের কর্মসংস্থান ও সঞ্চয়ী করে তোলার লক্ষ্যে উদ্যোক্তা অগ্রনী ভূমিকা পালন করে আসছেন।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির অধীনে প্রায় ১ হাজার ৫০০ নারী কর্মী নিয়োজিত রয়েছে। যাদের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে প্রতি মূহূর্ত এ উদ্যোক্তা কাজ করে যাচ্ছেন। উরসী মাহফিলা ফাতেহার মাধ্যমে বিভিন্ন দুস্থ অসহায় স্বামী পরিত্যাক্ত, গ্রামের দরিদ্র নারীরা কর্মের সন্ধান পেয়েছে। মিলেছে তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং হয়েছে সচেতন। পরিবারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। এতে করে নিজেদের উন্নতির সাথে সাথে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। অর্থনৈতিক মুক্তির ফলে নারী শিক্ষার অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, যেমন: সূচি কর্মের কাজ, হ্যান্ডপ্রিন্ট, ব্লক বাটিক, ভেজিটেবল ডাইং, স্কিন প্রিন্ট, টেলারিং, নকশী কাঁথা সেলাই, সচেতনতা মূলক প্রশিক্ষণ।

বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ২৫ জন স্থায়ী নারী কর্মী নিয়োজিত আছেন। আর ২০ জন সুদক্ষ সুপার ভাইজার প্রান্তিক পর্যায়ে উদ্যোক্তাকে তার উদ্যোগের সাথে সহযোগীতা করে চলেছেন। প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে যে সকল পণ্য গুলো তৈরি হয় তা দেশের বিভিন্ন স্থানে ও দেশের বাহিরে রপ্তানী করা হয়। এতে করে প্রতিষ্ঠানটি অর্থনৈতিক ভাবে উন্নতি করছে এবং গ্রামীন নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তিতে অবদান রাখছে। উদ্যোক্তা স্বীয় উদ্দ্যোগে নিজের দেশের তৈরি পন্য দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন মেলাতে প্রদর্শন ও বিক্রয় করছেন। যেমন: নেপাল, ভারত, চীন, জাপান, আমেরিকা, কানাডা এসব স্থানে পন্য রপ্তানী হচ্ছে। উদ্যোক্তাকে প্রতিকূলতা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়েছে এবং হচ্ছে।

এদিকে সময়ের সাথে সাথে নানা মানুষের নানা কথা ও বাঁধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি দেখেছেন, একজন নারীকে ঘর থেকে বের হয়ে যখন বাহিরের জগতে নিজের অবস্থানকে শক্ত ভাবে দাঁড় করতে হয় তখন নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজের জায়গা তৈরি করে নিতে হয়। বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ, যার অর্ধেক জনসংখ্যায় নারী। তাই দেশের এই অর্ধেক জন গোষ্টীকে পিছনে রেখে শুধু মাত্র পুরুষরাই দেশ ও জাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে না। এজন্য প্রয়োজন একে অপরের সহযোগিতা। পুরুষদেরও উচিত হাতে হাত রেখে কাঁধে কাঁধ মিলিযে সহযোগিতা করা, এতে করে যেমন প্রতিটি গ্রমীন পরিবারের অর্থনৈতিক উন্নতি হবে তেমনি নারী পুরুষ একে অপরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করলে দেশ ও জাতিকে অর্থনৈতিক ভাবে আরো শক্ত অবস্থানে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

নারী উদ্যোক্তা উরসী মাহফিলা ফাতেহা নিউজজিকে বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নারীদের উন্নতির পাশাপাশি অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এবং সামাজিক ভাবে মাথা উচুঁ করে দাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সহযোগীতা করে যাচ্ছেন। এবং এই সরকারের সময়কালেই সবচেয়ে বেশি নারীদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হয়েছে। বেড়ে উঠেছে অসংখ্য নারী প্রধান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান। ফলে তারা বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিতে অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে।

উরসী মাহফিলা ফাতেহা আরো বলেন, এই প্রতিষ্ঠান গুলো বিদেশে পন্য রপ্তানি করেও অর্থনৈতিতে অবদান রাখছে। যদি কেউ তার লালিত চিন্তা গুলোকে কাজে লাগায় তাহলে আরো অনেক বড় হস্ত শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। যেখানে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে। এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, মাথা উচুঁ করে দাঁড়াবে এদেশের নারী সমাজ; জয়তু বাংলাদেশ।

এই উদ্দ্যেক্তা গ্রামীণ অর্থনৈতিক র্কমকাণ্ডে পুরুষদের পাশাপাশি অংশগ্রহণ কারায় বিভিন্ন সময় নানা পুরষ্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০১৬ সালে নিজ  জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন। এরপর তিনি আনুষ্ঠিানিক ভাবে ২০১৭ সালে  বিভাগীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা পান। এই সম্মাননা পাওয়া তার কাজের প্রতি আরো উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছে।

উরসী মাহফিলা ফাতেহা বলেন, এই উদ্দ্যেগের কারণে আমি নিজে যথেষ্ট লাভবান হয়েছি। তাছাড়া যারা আমার সঙ্গে কাজ করছেন তাদের তো আয়-রোজগার করার মত কোন পথ ছিলো না। তারা আমার সঙ্গে কাজ করে যথেষ্ট ভাল আছে। তাদের সংসারে অভাব অনোটন বলতে কিছুই নেই। স্বামী সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে তারা ভাল আছে।

নতুন নারী উদ্দ্যেক্তাদের সর্ম্পকে আপনি কি মনে করেন এমন প্রেশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের ছোট বোন আছে, যারা উদ্দেক্তা হতে চান। তাদেরকে আমি বলবো যে, যেখানেই কাজ করতে চান না কেন? তাদেরকে অবশ্যই সেই বিষয়ে তার প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। সেই কাজ নিয়ে তার ভালভাবে গবেষণা থাকা প্রয়োজন। সে যে কাজই করুক না কেন, তাকে সেই কাজকে ভাল বাসতে হবে। কাজের প্রতি গুরুত্ব না দিলে সে ভালে উদ্দেক্তা হিসেবে গ্রহণ যোগ্যতা পেতে অক্ষম থাকবে।

এ নারী উদ্দ্যেগতা আরো বলেন, আমার সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ১ হাজার ৫০০ জন ব্যাক্তি কাজ করেন। তাদেরকে আমি ছেলে-মেয়েদের লিখাপড়ার করারো উপদেশ দেই এবং আমি তাদেরকে বাল্য বিবাহ বন্ধের জন্য উপদেশ দিয়ে থাকি। আমি সমাজিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে দেশের জন্য কাজ করে যেতে পারছি এজন্য আমি খুবই আনন্দিত।


   আরও সংবাদ