ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ ভাদ্র ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন পুড়ছে পরিকল্পিতভাবে


প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর, ২০১৯ ১৪:০০ অপরাহ্ন


পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন পুড়ছে পরিকল্পিতভাবে

   

আবদু্ল হামিদ : ফ্রান্সিস দে ওরেলানা। স্প্যানিশ এই পর্যটক প্রথম মানুষ যিনি আমাজন নদী ধরে পৌঁছে যান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেইন ফরেস্ট আমাজনে। যার আয়তন ৫৫ লাখ বর্গ কিলোমিটার। এই বনের বুক চিরে বয়ে গেছে এই আমাজন নদী। যে নদী প্রতি সেকেন্ডে ৪.২ মিলিয়ন ঘন ফুট পানি নিয়ে ফেলে সাগরে। গোটা পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে আমাজন। যে কারণে আমাজনকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। আর এটাকে এখন পরিকল্পিতভাবেই পুড়িয়ে দিচ্ছে স্বার্থবাদী মহল। এমনটাই দাবি করেছেন বিশ্বের বেশ কিছু গবেষণা সংস্থা। তাদের দাবি প্রতিবছরই আমাজন আগুনে পুড়ে। তবে এ বছরের আগুন লাগার ঘটনাকে মর্মাহত করেছে পুরো বিশ্বকে।

পৃথিবীর মানচিত্র খুললে দেখা যায় তার একটি বিরাট অংশ সবুজ চাদরে আচ্ছন্ন। আর বাংলাদেশের মতন এমন ৪৫ থেকে ৫০টি দেশের আয়তনের সমান এই আমাজান। যা বিশ্বের নয়টি দেশের মানচিত্র ছুয়েছে। সবগুলোর দক্ষিণ আমেরিকার দেশ নিয়ে আমাজন ফরেস্ট বিস্তৃত। দেশগুলো হলো- ব্রাজিল, পেরু, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, গায়ানা, সুরিনাম ও ফ্রেঞ্চ গায়ানা। যার মধ্যে ব্রাজিলের আছে আমাজনের ৬০ শতাংশ।

কিন্তু পৃথিবীর এই ফুসফুসে আজ স্বার্থবাদী মহল এর হিংস্র থাবায় গ্রাস হয়ে যাচ্ছে। এদিকে আমাজনে দাবানলের ঘটনা বাড়ার বিষয়টি বন উজাড় করার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত- এমনটাই দাবি করেছে আমাজন এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট ও ব্রাজিলের ফেড্যারাল ইউনিভার্সিটি অব একর। এবং তারা নতুন এক গবেষণায়  দেখিয়েছে যে দশটি মিউনিসিপালিটি এলাকায় বন উজাড় করার বিষয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। ঠিক সেই এলাকা গুলোই এবছরের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। আর বন উজাড় করা আর দাবানলের মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলে ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চলের খরা থেকে আগুনের সূত্রপাতের তত্ত্বটিকে আবার ভুল হিসেবে ধরে নিতে হয়।

এই গবেষণায় উঠে আসে যে শুষ্ক মৌসুমে এরকম দাবানল ছড়িয়ে পড়ার সাথে খরার সম্পর্ক থাকার সম্ভাবনা খুবই সামান্য। যেখানে অন্যান্যবারের চেয়ে এবার খরার তীব্রতা অন্যসময়ের চেয়ে অনেক কম। গবেষণায় দেখা গেছে, "সবচেয়ে বেশি পরিমাণ আগুনের ঘটনা যে দশটি মিউনিসিপালিটিতে হয়েছে। সেখানেই সবচেয়ে বেশি মাত্রায় বন উজাড় হয়েছে। ২০১৯ সালের আগুনের ৩৭ শতাংশ হয়েছে এই দশটি স্থান থেকে, আর এবছরের জুলাই পর্যন্ত মোট উজাড় করা বনের ৪৩ শতাংশ হয়েছে এসব এলাকাতে। নতুন করে বৃক্ষহীন হওয়া ও কিছুটা খরায় ভুগতে থাকা এলাকায় দাবানলের ব্যাপকতা আগুনের চরিত্রের একটি বিষয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। সেটা হল কোন এলাকা বৃক্ষহীন করে ফেললে সেটা নতুন ওই এলাকাকে জ্বালিয়ে দেয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করে।"

গবেষকরা তিনটি আলাদা সূত্র থেকে তথ্য নিয়ে এই গবেষণা পরিচালনা করেছেন আমাজন এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট ও ব্রাজিলের ফেড্যারাল ইউনিভার্সিটি অব একর। এতে দেখানো হয়েছে। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাসের বন উজাড় করার তথ্য এবং বছরের শুরু থেকে আগাস্টের ১৪ তারিখ পর্যন্ত হওয়া দাবানলগুলোর তথ্য আমলে নেয়া হয়েছে গবেষণাটিতে।

এই গবেষণায় দাবি করা হয়, "২০১৯ সালে আমাজনে যে পরিমাণ আগুনের ঘটনা ঘটেছে তা শুধু শুষ্ক মৌসুমের কারণে নয়। অধিকাংশ রাজ্যেই আগুনের ঘটনা গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে হয়েছে। আগাস্টের ১৪ তারিখ পর্যন্ত আগুনের ঘটনা ঘটেছে ৩২ হাজার ৭২৮টি, যা একই সময়ে গত তিনবছরের গড়ের চেয়ে প্রায় ৬০ শতাংশের বেশি।" অপর দিকে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জাইর বোলসোনারো ফেসবুক লাইভে স্বীকার করেন যে আমাজনে বন উজাড় করার হার বেড়েছে এবং তিনি দাবি করেন যে 'আমাদের আমাজনকে পুড়িয়ে দেয়ার মতো অপরাধ' দমন করার উদ্দেশ্যে কাজ করছেন তিনি।

তবে দাবানল যে পৃথিবীতে স্বাভাবিক একটি বিষয়, সেটিও উল্লেখ করেন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো। "বনে আগুন লাগে, এটি সাধারণ বিষয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে হয়, ব্রাজিলেও হতে পারে। এখানে হলে কি কোনো অপরাধ? আমি জানি না কৃষকরা, এনজিওরা নাকি আদিবাসীরা এই আগুনের পেছনে রয়েছে। অন্যান্য দেশের স্বার্থ রয়েছে এর পেছনে। এরকম ঘটনা ঘটলে তারা বলতে পারে যে, তোমরা সঠিক কাজটা করছো না। তারপর কে জানে, কয়েকদিন পর আমাজন অঞ্চলেরও ওপরও কেউ হস্তক্ষেপ করে কিনা।

একই সময় আরেকটি টুইটার বার্তায় ব্রাজিলের পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রী রিকার্ডো সালেস বলেন জলবায়ু পরিস্থিতির কারণেই আগুনের ঘটনা বাড়ছে।"শুকনো আবহাওয়া, বাতাস ও তাপের কারণে সারা দেশে আগুন লাগার হার বৃদ্ধি পেয়েছে।

ইমাফ্লোরা ইন্সটিটিউটের গবেষক লুইস ফার্নান্দো গুয়েদেস পিন্টো দাবি করেন, আগুন সংক্রান্ত বর্তমান তথ্য যাচাই করলে বোঝা যায় যে আমাজনে জায়গা নিয়ে বিরোধের কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে আগুন লাগার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই "জায়গা নিয়ে বিরোধের কারণেই এই আগুনের ঘটনা দিন দিন ঘটেই চলেছে। এলাকা পরিষ্কার করা ও দখল করার উদ্দেশ্যে আগুন লাগানো হয়েছে। এবং কাগজে কলমে জমির মালিকানা পরবর্তীতে পরিবর্তন করার উদ্দেশ্য নিয়েই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।"

অপর দিকে লুইস ফার্নান্দো বলেছেন এর আগে জাইর বোলসোনারো এবং একরের গভর্নর গ্ল্যাডসন কামেলি'র মত নেতাদের বক্তব্যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে যারা বন ধ্বংস করে তাদের শাস্তির বিধান কিছুটা শিথিল করা হতে পারে। এই শাস্তি কমানোর বিষয়টির সাথে এবছরের আগুন লাগার মাত্রা বৃদ্ধির সম্পর্ক আছে বলে দাবি করেন লুই ফার্নান্দো। এই আগুনগুলো এমন একটি পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে। যার ফলস্বরুপ কারো কোনো শাস্তি হবে না বলে এর আগেই জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যের শীর্ষ কর্মকর্তারা। জলবায়ুর কারণেই আগুন বেশি লাগছে - বাহিয়া রাজ্যে পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রীর এমন এক বক্তব্যের প্রতিবাদ ও করেছিল সেখানে উপস্থিত সাধারণ জনগণ।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ কার্রোস নোবরের বলেন, বন উজাড় করা এবং আগুনের মধ্যে সম্পর্ক যে রয়েছে, তা আগে থেকেই অনুমান করা হয়ে আসছিল। যারা সাধারণত বনের একটি অংশ 'পরিষ্কার' করতে চায়, তারা শুরুতে গাছ কেটে পরে সেই এলাকায় চিহ্নিত করে আগুন লাগিয়ে দেয়। আর এটা করা হয় পরিকল্পিতভাবে গাছ কাটার পরের দিনই যদি আগুন লাগিয়ে দেয়া হয় তবে আগুন ছড়াবে না। কারণ তখনও সেখানকার উদ্ভিদকুল অনেকটাই সবুজ থাকে। তাই আগুন লাগার জন্য অন্তত দুই মাস অপেক্ষা করতে হয় স্বার্থবাদীদের। য়ার মধ্যে প্রতিবছরই আগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে আগুনের সংখ্যা থাকে সবচেয়ে বেশি। এবছর সব সংস্থা থেকে পাওয়া নির্দেশক অনুযায়ী বন উজাড় বেশি হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া যায়। কাজেই আগুন লাগার হারও বেশি হবে তা ধারণা করা যাচ্ছিল বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্রোস নোবরে।

বিশ্ব নেতাদের এমন সব মন্তব্য স্পষ্ট করে যে, পৃথিবীর ফুসফুস আমাজন বন কে পরিকল্পিতভাবে পুড়িয়ে ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে একটি স্বার্থন্বেষী মহল। কিন্তু কিছু এনজিও গবেষক আশঙ্কা করছে যে এ অরণ্য যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীতে বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।


   আরও সংবাদ