ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ ভাদ্র ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

ভৈরবনদ দখল করে এবিসিডি কলেজ শিক্ষকের নেতৃত্বে মাছচাষ!


প্রকাশ: ২২ অক্টোবর, ২০১৯ ১৪:০০ অপরাহ্ন


ভৈরবনদ দখল করে এবিসিডি কলেজ শিক্ষকের নেতৃত্বে মাছচাষ!

   

চৌগাছা (যশোর) প্রতিনিধি : যশোরের চৌগাছা উপজেলায় ভৈরব নদের ১২ কিলোমিটার অংশে খননকাজ শেষ হয়েছে। এরমধ্যে নদের প্রায় অর্ধ কিলোমিটার অংশ দখল করে মাছচাষ করা হচ্ছে। এ মাছচাষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা ও এবিসিডি কলেজের শরীরচর্চা বিষয়ের শিক্ষক ওহিদুল ইসলাম ইকবাল। আর নদে মাছচাষে তাঁকে সহায়তা করছেন তাঁর অন্য চার ভাই।

নদের চৌগাছা উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের তাহেরপুর বুড়ি বটতলা কালভার্ট থেকে লক্ষীপাশা কালভার্ট পর্যন্ত ৪৫০ মিটার এলাকায় গত প্রায় চার মাস ধরে রুই, কাতলা, সিলভার কার্প, তেলাপিয়া মাছ চাষ করা হচ্ছে।

ওহিদুল ইসলাম ইকবাল হাকিমপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সদ্য সাবেক আহ্বায়ক। বর্তমানে ইউনিয়নটিতে যুবলীগের কমিটি নেই। নতুন করে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। তিনি উপজেলার এবিসিডি কলেজের শরীর চর্চা শিক্ষক। তাঁর বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য সহিদুল ইসলাম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের (সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া প্রস্তাবিত কমিটির) কৃষি বিষয়ক সম্পাদক। তবে নদে মাছচাষের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওহিদুল ইসলাম ইকবাল ও শহিদুল ইসলাম দু'ভাই।

পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কার্যালয় সূত্র জানা যায়, ২৭২ কোটি ৮১ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ব্যয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি ‘ভৈরব রিভার বেসিন এলাকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প’ চলমান রয়েছ। প্রকল্পের আওতায় চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর থেকে যশোর সদর উপজেলার আফ্রা পর্যন্ত ৯২ কিলোমিটার এলাকা খনন করা হবে। ইতিমধ্যে চৌগাছা অংশের নদের ১২ কিলোমিটার খননকাজ শেষ হয়েছে। নদের চৌগাছা শহর সংলগ্ন অংশে সরকারিভাবে মাছের পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চৌগাছা অংশে নদের ওপর অপরিকল্পিত নির্মিত ১৬টি সেতু ও কালভার্ট রয়েছে। সেতু ও কালভার্টের অংশে নদ খনন করা হয়নি। এতে নদে এখনও স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ শুরু হয়নি। নদের ওই অংশগুলোতে বাঁধ হয়ে অনেকটা মাছ চাষের ভেড়ির (পুকুরের) রূপ ধারণ করেছে। 

এই সুযোগে নদ দখল করে মাছ চাষ করছেন উপজেলার আরাজি সুলতানপুুুর গ্রামের বাসিন্দা অহিদুল ইসলাম ইকবাল, তাঁর ভাই শহিদুল ইসলাম, আলাউদ্দিন, জালাল উদ্দিন এবং মহিরুল ইসলাম। মাছ চাষে কেউ ঝামেলা না করতে পারে এজন্য অংশীদারিত্বের টোপ দিয়ে গ্রামবাসীদের মাছচাষে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তাঁদের নিকট থেকে শেয়ার হিসাবে এক থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। 

তাঁরা জানান, আগে বুড়ি বটতলা কালভার্ট থেকে লক্ষীপাশা কালভার্ট পর্যন্ত ৪৫০ মিটারে নদের পানিতে ও দুই পাড়ে আগাছানাশক দিয়ে শ্যাওলা, কচুরিপানা ও ঘাস মারা হয়েছে। এরপর চুন দিয়ে পানি পরিস্কার করে মাছ ছাড়া হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার তাহেরপুর রিসোর্ট থেকে ভৈরব দক্ষিণ মুখি হয়েছে। তাহেরপুর রিসোর্ট সেতু থেকে প্রায় ৯০০ মিটার দূরে নদের ওপর বুড়ি বটতলা কালভার্ট। সেখান থেকে ৪৫০ মিটার দক্ষিণে লক্ষীপাশা কালভার্ট। দুই কালভার্টের অংশে নদ খনন না করায় বাঁধের মতো হয়ে পুকুরের ন্যায় হয়ে আছে। নদের ওই অংশে মাছচাষ করা হচ্ছে। নদের পাশে সবজিক্ষেত পরিচর্যা করছিলেন তাহেরপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তার। 

তিনি বলেন, ‘নদে মাছ চাষ করছেন ইকবাল ও তাঁর ভাইয়েরা। গ্রামের লোকজনও আছে তাঁদের সাথে। এজন্য কাউকে নদের ওই অংশে নামতে দেওয়া হয় না। যে মাছ ছাড়া হয়েছে তার ওজন প্রায় ৪০০/৫০০ গ্রাম হয়ে গেছে।’ 

তিনি আরও বলেন, পাশের অংশের পানি দেখলেই বুঝতে পারবেন ওই অংশে মাছ চাষ হচ্ছে। পাশের অংশে পাট জাগ (পঁচাতে) দেয়ায় পানির রং কালচে হয়ে গেছে। কিন্তু মাছ চাষ করা অংশে কাউকে নামতেও দেয়া হয়নি পাট জাগ দিতেও দেয়া হয়নি। এ কারণে পানির রং পরিস্কার নদীর পানির মতই রয়েছে। গ্রামের কয়েকজন পাট জাগ দিতে চাইলেও তাদের দিতে দেয়া হয় নি।'

একটি সূত্র জানিয়েছে উপজেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ দু'নেতা কয়েকদিন আগে স্থানীয় এমপি মুক্তিযোদ্ধা মেজর জেনারেল (অব) নাসির উদ্দিনের উপস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নদ দখল করে মাছ চাষকারীদের একটি তালিকা দিয়েছেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার সংসদ সদস্যকে আস্বস্ত করেছেন তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। কাউকে নদ দখল করে রাখতে দেয়া হবে না। তবে এখনো এবিষয়ে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় পাশের অন্য খন্ডগুলিতেও মাছ চাষের পরিকল্পনা করছে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। 

আরাজি সুলতানপুুুর গ্রামের আজিজুর রহমান বলেন,‘গ্রামের ইকবাল ও তাঁর ভাইয়েরা মিলে নদে মাছচাষ করছেন। শুনেছি, গ্রামের প্রায় সবাই মাছচাষের সাথে আছেন। তাঁরা এক থেকে দুই হাজার টাকা দিয়ে শেয়ার কিনেছেন। তবে আমি কোনো শেয়ার কিনিনি।’ 

গ্রামের কোরবান আলী বলেন,‘ইকবালরা কয়ভাই যোগাযোগ করে মাছচাষ করেছে। গ্রামের লোকও আছে। এখন টিএনও অফিসেরতে (ইউএনও অফিস থেকে) মাছচাষ নিষেধ হয়ে যাচ্ছে। ভাগের কাজ আমার ভালো লাগে না। আমি এতে নেই।’

উপজেলার হাকিমপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর (আরাজি সুলতানপুর-দেবীপুর) ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন,‘এক পার্টি নদে মাছ ছেড়ে দিয়েছে। প্রায় চার মাস আগে নদ খননের পর গ্রামের ইকবাল প্রথম নদে মাছ ছাড়েন। এতে গ্রামের লোকজন গ্যাঞ্জাম শুরু করে। পরে গ্রামের লোক শেয়ার হয়েছে। গ্রামের বেশিরভাগ লোক আছে মাছচাষে। আমি চাই নদ উন্মুক্ত থাকুক। সারা দেশে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করছে সরকার। সেখানে এঁরা কীভাবে নদে মাছচাষ করে?’

হাকিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাসুদুল হাসান বলেন,‘শুনেছি ইকবাল ও শহিদুলের নেতৃত্বে আরাজি সুলতানপুুুর গ্রামের মানুষ নদে মাছচাষ করছেন।’

তবে মাছ চাষের কথা অস্বীকার করে ওহিদুল ইসলাম ইকবাল বলেন, আমরাতো কোনো মাছচাষ করছি না। আমাদের এদিকে কোনো ঝামেলা নেই। আপনাকে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে। এখানে দলীয় গ্রুপিং আছে তো। তারা ঝুট ঝামেলা বাধানোর পাঁয়তারা চালাচ্ছে। জাল টানলেতো বোঝা যাবে। দুই পাশেতো কালভার্ট রয়েছে। মাছ চাষ করলে বাঁধ দিতে হবে। নদে মাছচাষ হচ্ছে না। নদ উন্মুক্ত আছে।’

প্রায় একই কথা বলেন শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন,‘মাছ চাষ করছি না। এটা মিছে কথা। আর ওখানে কে মাছচাষ করবে? মাছচাষ করার মতো পানিও নেই ওখানে। আমার জানামতে নদে কেউ মাছচাষ করছে না। এটা সম্পূর্ণ বানোয়াট। ওই মাছচাষের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।’

চৌগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নদের জায়গা দখল করে মাছচাষের কোনো সুযোগ নেই। সরেজমিনে দেখে সেইরকম কিছু হয়ে থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, ‘নদ দখল করে মাছ চাষের বিষয়টি আমি শুনেছি। কোনোভাবেই নদ দখল করে মাছচাষ করতে দেওয়া হবে না। কালভাটের ওই অংশ দ্রুত কেটে দেওয়া হবে।’


   আরও সংবাদ