ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ ভাদ্র ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৫

সরকারিভাবে আমন ধান ক্রয় নিয়ে অভিযোগ, দায় এড়াতে পরিদর্শনে যান কমিটি


প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারী, ২০২০ ১৩:০০ অপরাহ্ন


সরকারিভাবে আমন ধান ক্রয় নিয়ে অভিযোগ, দায় এড়াতে পরিদর্শনে যান কমিটি

   

 আব্বাস উদ্দিন : যশোরের মণিরামপুরে সরকারি খাদ্য গুদামে ন্যায্যমূল্যে আমন ধান সংগ্রহে ক্রয় কমিটির বিরুদ্ধে লটারীর মাধ্যমে অসংখ্য ভূয়া কৃষকের তালিকা প্রকাশ এবং কৃষি অফিসের যোগসাজসে প্রকৃত কৃষকদেরকে তালিকা থেকে কৌশলে বাদ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। 

কৃষি অফিসের দেয়া ৪৫ হাজার কৃষকের মধ্য থেকে গত বছরের ২ ডিসেম্বর উপজেলা খাদ্য ক্রয় কমিটি লটারির মাধ্যমে ২ হাজার ১’শ৫০ জন কৃষকের তালিকা প্রকাশ করে ২২ ডিসেম্বর থেকে ধান ক্রয় শুরু করেন বলে উপজেলা খাদ্য গুদামের ইনচার্জ মনিরুজ্জামান মুন্না জানান। কিন্তু ক্রয় কমিটির কৃষক বাছাই নিয়ে বঞ্চিত কৃষকেরা ও বিভিন্ন থেকে প্রশ্ন উঠেছে। কবে কখন এই তালিকা করা হয়েছে বিষয়টি তেমন প্রচারনায় না আসায় এ নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে সরকারিভাবে আমন ধান ক্রয় কমিটি কর্তৃক বাছাইকৃত কৃষকদের তালিকায় অসংখ্য অসংগতি ও ভুলে ভরা থাকায় এ তালিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে নানান প্রশ্ন উঠেছে। তাছাড়া ধান ক্রয় কার্যক্রম কচ্ছপ গতিতে হওয়ায় অনেক তালিকাভুক্ত কৃষক খোলা বাজারে পানির দরে ধান বিক্রয় করে দেয়ায় সরকারি মূল্যে ধান বিক্রয় করতে না পেরে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন

ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অভিযোগ, সরকারি খাদ্যগুদামে ধান বিক্রি করতে আসার পর ধানের মান নিয়ে তালবাহানা করাসহ বিভিন্ন অজুহাতে কাল-বিলম্ব করায় অনেকেই ধান বিক্রি করতে না পেরে ফিরে যাচ্ছে। একটি কথিত সিন্ডিকেট এবারও ধান ক্রয় কার্যক্রম কৌশলে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে কৃষকেরা এ ধরনের সমস্যায় পড়ছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করেন। 

তবে এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়, দাবী করে সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষ বলছেন, আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় মানসম্মত ধান ক্রয় করতে যেতে একটু বিলম্ব হচ্ছে। এদিকে উপজেলার একাধিক সাধারণ নারী-পুরুষ অভিযোগ তুলেছেন তাদের কোন জমি নেই অথবা ধান চাষ করেননি অথচ তাদের নাম নাকি লটারীর মাধ্যমে আমন ধান বিক্রয়ের তালিকায় নাম প্রকাশ করা হয়েছে।  

উপজেলার রোহিতা ইউনিয়নের স্মরণপুর গ্রামের ভ্যান চালক শাহজাহানের স্ত্রী আছিয়া বেগম একটন আমন ধান সরকারি মূল্যে খাদ্য গুদামে দিতে পারবেন মর্মে ৬১ নম্বর তালিকায় তার নাম রয়েছে। অথচ এই আছিয়া বেগম জানালেন, তিনি কোন ধান চাষ করেননি। 

তালিকার ১৩৮ নম্বরে নাম রয়েছে প্রতিবেশী মৃত আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী জাহানারা বেগমের। তিনিও দিতে পারবেন একটন। তিনিও জানিয়েছেন তার কোন জমি নেই। জলকর রোহিতা এলাকার সাধন বিশ্বাসের নাম পাওয়া গেছে তালিকার ১২৩ নম্বর ক্রমিকে। সাধন বিশ্বাস বর্তমানে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন পাশ্ববর্তী কেশবপুর উপজেলায়।

১৬২ নম্বর ক্রমিকে নাম রয়েছে তরিকুল ইসলামের। অথচ এই তরিকুল রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ১২৫ নম্বর ক্রমিকে দোঁদাড়িয়া গ্রামের বাবর আলীর পুত্র ফিরোজ হোসেন দেড় টন ধান দিতে পারবে। অথচ ফিরোজ একজন ট্রলি চালক, তার কোন ধান নেই। পাশ্ববর্তী হানুয়ার গ্রামের পূর্ব পাড়ায় ১২১ ক্রমিকে দিলীপ মন্ডল, ১২২ ক্রমিকে নিরোধ মন্ডল, ১২৩ ক্রমিকে নির্মল সরকার, ১২৪ ক্রমিকে নিশীথ মালিসহ একই গ্রামের ২২ জন ব্যক্তির নাম আমন ধানের তালিকায় দেখে তারা সবাই হতবাক হয়েছেন।

চন্ডিপুর গ্রামে অনেক ব্যক্তির নাম আমন ধানের তালিকায় ঢুকানো হয়েছে বলে অভিযোগ। এছাড়া উপজেলার মাহমুদকাটি এলাকার আলমগীর ও আমিনুল, কদমবাড়ীয়া গ্রামের রফিক গাজী এবং গাংড়া এলাকার হুমায়ুন কবীরসহ অসংখ্য ব্যক্তির নাম নাটকীয়ভাবে লটারীর মাধ্যমে তালিকায় ঢুকিয়ে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে কৃষি কার্ড প্রস্তুত করা হয়েছে। 

জানা যায়, লটারীর মাধ্যমে তৈরী করা তালিকা অনুযায়ী ২ হাজার ১’শ ৫০ জন কৃষক সরকারি ন্যায্যমূল্যে অথার্ৎ ১ হাজার ৪০ টাকা মন দরে খাদ্য গুদামে এবার আমন ধান বিক্রি করতে পারবেন। অভিযোগ উঠেছে উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় একইভাবে আমন ধান সংগ্রহের নামে কৃষি কার্ড তৈরী করে তালিকায় ভূয়া নাম প্রকাশ করা হয়েছে। 

ফলে এ উপজেলার প্রকৃত অধিকাংশ কৃষক ন্যায্যমূল্যে গুদামে ধান দেয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অপর দিকে উক্ত তালিকায় যে সমস্ত কৃষকদের নাম রয়েছে তারা গুদামে ধান দিতে আগ্রহী থাকলেও কর্তপক্ষের কাল-বিলম্ব ও হয়রানি করার কারণে তারা সরকারি খাধ্যগুদামে ধান বিক্রি করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

সরকারের মহতি উদ্যোগে কৃষকদের আশা-ভরসা ছিল সরকারি মূল্যে ধান বিক্রি করে লাভবান হবেন। কিন্তু সেটা সম্ভব না হওয়ায় অধিকাংশ কৃষককে বর্তমান বাজারদরে সস্তায় ধান বিক্রি করে ধারদেনা পরিশোধ করে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। আর এই সুযোগে কথিত সিন্ডিকেটের লোকজন কৃষকের কাছ থেকে সস্তায় ক্রয় করে মজুতকৃত ধান গুদামে ঢোকায়ে মুনাফা লুটতে ভুয়া কৃষকের কার্ড যোগাড় করার কাজে লিপ্ত আছেন।

অভিযোগ উঠেছে, পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক কৃষি দপ্তর ও খাদ্য গুদাম কর্তপক্ষ যৌথভাবে সিন্ডিকেট চক্রের সাথে যোগসাজসে উক্ত তালিকা প্রকাশ করেছে। সে কারণে উপজেলার প্রকৃত কৃষকরা চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। 

জানা যায়, সরকারি ন্যায্যমূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে এবারের আমন ধান সংগ্রহে ২০১৯ সালের নভেম্বরের মধ্যে ক্রয় সম্পন্ন করার কথা থাকলেও তা উদ্বোধন করা হয় গত ১২ ডিসেম্বর।

লক্ষ্যমাত্রার ২ হাজার ৫’শ ৩১ টনের মধ্যে উদ্বোধনের দিন থেকে গত ২৩ দিনে ৩২০ টন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে বলে কর্তপক্ষের দাবী। এদিকে অজ্ঞাত কারণে মুখ চিনে ধান সংগ্রহের কারণে প্রস্তুত করা তালিকার প্রকৃত কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। 

তাছাড়া, ধান সংগ্রহের জন্য কবে, কখন ও কোথায় লটারী করা হয়েছে তা অধিকাংশ কৃষকরা জানেনা। তবে, কতর্ৃপক্ষের দাবী লটারীর মাধ্যমে যে সমস্ত কৃষকরা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের নামের তালিকা খাদ্য গুদাম এলকায় টানিয়ে দেয়াসহ পৌর শহরে মাইকিং করা হয়। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান মুন্না বলেন, আমি ক্রয় কমিটির সদস্য না। আমি কেবল ক্রয় কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার দায়িত্বে নিয়োজিত আছি। কৃষি অফিসের তালিকা অনুযায়ী ক্রয় কমিটি যে তালিকা বাছাই করে দিয়েছেন তাদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা হচ্ছে। কোন সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গুদামে ধান দেয়ার কোন সুযোগ এবার নেই বলে তিনি দাবী করেন।

কৃষকদের নিকট থেকে সময়মত ধান সংগ্রহে কালক্ষেপন করা হচ্ছে এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবী করেন, প্রাকৃতিক দূযোর্গ এবং ধানের মান পরিপূর্ণ না থাকায় গুদামে তা নিতে বিলম্ব হচ্ছে।

 উপজেলা কৃষি অফিসার হিরক কুমার সরকার খাদ্য গুদাম কর্তপক্ষের সাথে যোগসাজসে তালিকা তৈরীর বিষয়টি অস্বীকার করে দাবী করেন, উর্দ্ধতন কর্তপক্ষের নির্দেশে সময়মত লটারীর মাধ্যমে আমন ধান দিতে পারবে এমন কৃষকদের নির্বাচিত করা হয়েছে। 
 
তিনি জানান, ২০১৪ সালের পূর্বে করা ক্ষুদ্র, প্রান্তিক,মাঝারি ও ধনী শ্রেণির কৃষকদের তালিকা থেকে ৪৫ হাজার কৃষকের তালিকা উপজেলা খাদ্য-শস্য ক্রয় কমিটির কাছে সময়মত দেয়া হয়।

জানা মতে, তালিকার নির্বাচিতরাই প্রকৃত কার্ডধারী কৃষক। এসব কৃষকরা তাদের ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে গুদামে ধান দিতে পারবেন।

জানতে চাইলে, কৃষকদের নিকট থেকে আমন ধান ক্রয় কমিটির সভাপতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার আহসান উল্লাহ শরিফী বলেন, উপজেলা কৃষি অফিসের দেয়া তালিকা থেকে লটারীর মাধ্যমে কৃষক বাছাই করা হয়েছে।তালিকায় ত্রুটি থাকলে সে দায়ভার সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের নিতে হবে। 

লটারির দিন গত ২ ডিসেম্বর ক্রয় কমিটির সদস্য সচিব  উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মামুন হোসেন খান, উপজেলা কৃষি অফিসার হীরক কুমার সরকার, মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মৌসুমী আক্তার, সমবায় কর্মকর্তা নাসিমা খানম, কৃষক প্রতিনিধি ফজলুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার আরও জানান, বিভিন্ন অভিযোগ ও ধান ক্রয় নিয়ে নানা প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ার পর গত ১৪ জানুয়ারি খাদ্যগুদাম পরিদর্শনে যেয়ে ধান বিক্রি করতে আসা কৃষকদের সাথে কথা বলে খোঁজ নিয়েছি এবং ধান ক্রয় কার্যক্রম তদারকি করেছি। তালিকা প্রনয়নে যারা অনিয়ম করেছে তাদের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।


   আরও সংবাদ