ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ ভাদ্র ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

৪০০ বছরের পুরানো প্রন্ততত্ব নরসিংদীর তিন গম্বুজ দেওয়ান মসজিদ


প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারী, ২০২০ ১৩:০০ অপরাহ্ন


৪০০ বছরের পুরানো প্রন্ততত্ব নরসিংদীর তিন গম্বুজ দেওয়ান মসজিদ

   

নরসিংদী থেকে বোরহান মেহেদী : নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায় রয়েছে মোগল আমলের মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন তিন গম্বুজ মসজিদ। চারশ বছর আগের ঐতিহাসিক পারুলিয়ার তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে রয়েছে ঈশা খাঁর পঞ্চম অধস্তন পুরুষ দেওয়ান শরিফ খাঁ ও তার স্ত্রী মুর্শিদকুলি খাঁর কন্যা জয়নব বিবির যুগল মাজার। ১৭১৯ হিজরীতে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেন জয়নব বিবি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭২২ পর্যন্ত বর্তমান নরসিংদী (ঢাকা জেলার এ অঞ্চলে মহেশ্বরদী) নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবেদার নিযুক্ত হন ও তার কনিষ্ঠ কন্যা বিবি জয়নবকে ঈশা খাঁর পঞ্চম অধস্তন পুরুষ মনোয়ার খাঁর পঞ্চম ছেলে দেওয়ান শরিফ খাঁর সাথে বিবাহ দিয়ে জামাতাকে মহেশ্বরদী পরগনার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। 

তখন থেকেই তিনি দেওয়ান শরিফ খাঁ নামে পরিচিতি লাভ করেন এবং এলাকার নামকরণ করা হয় শরীফপুর। হুসেইন শাহী শাসন আমলে ধনপদ সিংহ নামে এক রাজা ছিল। তার পুত্র রাজা নরসিংহ শীতলক্ষ্যার তিন মাইল পূর্বে ব্রহ্মপুত্রের তীরে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেন এবং তার নামে স্থানের নামকরণ করেন নগর নরসিংহপুর। আজো নগর নরসিংপুর গ্রাম বিদ্যমান আছে । কালের আবর্তে শরীফপুর নামের বিলুপ্ত ঘটে।

সে সময় ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে বড় বড় পাল উড়িয়ে নৌকা যাতায়াত করত। তখন এলাকাবাসী পালের নৌকা দেখতে নদের তীরে যেত, তখন থেকেই নামের সংস্করণ হয়ে পারুলিয়া হয়। 

অনেকে বলেন নৌকায় নদী পারাপার হতো বলে এর নামকরণ পারুলিয়া হয়। ১৭১৯ হিজরীতে দেওয়ান শরিফ খাঁর স্ত্রী জয়নব বিবি এলাকার মানুষের চাহিদা মোতাবেক মসজিদটি নির্মাণ করেন। মসজিদের আওতায় রয়েছে ১২ বিঘা জমি। এখানে রয়েছে চারটি শান বাঁধানো পুকুরঘাট। মসজিদটি ৫ ফুট প্রস্থ দেয়াল, তার মধ্যে মজবুত পাথর দিয়ে খিলানের উপর ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য মসজিদটি নির্মিত। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি প্রধান গেইট, পূর্ব দিকে তিনটি দরজা, উত্তর-দক্ষিণে একটি করে দরজা। মসজিদের পাকা বেষ্টনী প্রাচীরের অভ্যান্তরে রয়েছে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে সুউচ্চ দু’টি মিনার। মসজিদের কারুকাজ অত্যন্ত শিল্প সুষমা মণ্ডিত।

জানা যায়, ইরান, বাগদাদ, ইয়েমেন দেশ থেকে কারিগর এনে মসজিদের নির্মাণ ও কারুকাজ করা হয়। পারুলিয়ার অন্য নাম নগর নরসিংহপুর। মসজিদের সম্মুখভাগের ওপর একটি স্মৃতিফলকে লেখা আছে ‘লা-ইলাহা ই্ল্লালাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’ কার্দে জয়নব বিনতে নাছের জজায়ে দেওয়ান শরিফ, হিজরি ১০২০ সাল। এ প্রাচীন ঐতিহাসিক মসজিদটি ৪’শ বছর আগে নির্মিত হলেও আজো আপন শিল্পকর্মে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পলাশ উপজেলার নিবিড় পল্লীতে শান্ত পরিবেশে মসজিদটি অবস্থিত। ১৯০৪ সালে প্রচন্ড ভূমিকম্পে মসজিদের ছাদে একটি ফাটল দেখা দেয়, আর ভূমিকম্পে ধবংশ হয়ে যায় দেওয়ান সাহেবের কাচারিঘর, নায়েব সাহেবের ভবনটি।

মসজিদের পূর্ব কোণে কয়েকটি প্রাচীন কবর। মসজিদের বারান্দায় প্রবেশ দরজায় উপরিভাগে ফার্সি ভাষায় লেখা আছে মসজিদ তৈরির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পাঠোদ্ধারে জানা যায়, ১১২৮ হিজরিতে নাছেরের কন্যা দেওয়ান শরিফের স্ত্রী জয়নব বিবি মসজিদটি তৈরি করেন। মসজিদের পশ্চিম পাশে পুকুরের পূর্ব তীরে এক গম্বুজবিশিষ্ট সৌধ। পাশাপাশি দু’টি কবর। জানা যায়, ১১২৮ হিজরীতে দেওয়ান শরিফ খাঁ ইন্তেকাল করেন। তার স্ত্রীর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী পরের বছর জয়নব বিবি মারা গেলে স্বামীর পাশেই তাকে দাফন করা হয়। 

এখনো প্রতিদিন শত শত মুসল্লি মসজিদে নামাজ আদায়সহ মাজার জিয়ারত করেন। দেওয়ান শরিফ খাঁর বংশের কোনো মানুষ মসজিদ ও মাজারের তত্ত্বাবধানে নেই। তার বংশের দেওয়ান মুহম্মদ সাত্তারদাদ খাঁর ছেলে ফতোদাদ খাঁ বর্তমানে জীবিত আছেন। তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়া উপজেলার হযরত নগরে বসবাস করেন। ঈশা খাঁর বংশধরও তিনি। তিন গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদে ভূমিকম্পে ফাটল দেখা দিলে ১৯৮৯ সালে স্থানীয় লোকজন সংস্কার করে। এর পরিবর্তে গত ২০১২ সালে মসজিদটি পুনঃসংস্কারের কাজ হয়।


   আরও সংবাদ