ঢাকা, বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ ভাদ্র ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে নারী পাচার, গ্রেফতার ৮


প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারী, ২০২০ ১৩:০০ অপরাহ্ন


ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে নারী পাচার, গ্রেফতার ৮

   

নারায়ণগঞ্জ থেকে শাওন : বিদেশে ড্যান্সবারে উচ্চ বেতনে চাকুরির প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার সহস্রাধিক তরুণী ও নারীকে পাচারের অভিযোগে আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্রের আট সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব-১১। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ট্রাভেল এজেন্সি ও নাচের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ড্যান্সক্লাবের মালিকও রয়েছেন।

গত রোববার রাতে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর, কেরাণীগঞ্জ ও মুগদা এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই নারীকে উদ্ধারসহ আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে নারীদের বিপুল পরিমাণ পাসপোর্ট, ভিসার ফটোকপি ও নথিপত্রসহ পাচারের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। 

সোমবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে র‍্যাব-১১ সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব-১১ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানানো হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হলেন- রাজধানীর কাকরাইল এলাকার ধানসিঁড়ি ট্রাভেল এজন্সির মালিক শাহাবুদ্দিন (৩৭), নারায়ণগঞ্জের একটি নাচের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মালিক ও তরুণী সংগ্রহকারী এজেন্ট রিজভী হোসেন অপু (২৭), পাচারকারী চক্রের এজেন্ট হৃদয় আহম্মেদ কুদ্দুস (৩০), মামুন (২৪), স্বপন হোসেন (২০), শিপন (২২), মুসা (২৮)ও নারী সদস্য শিল্পী আক্তার (২৭)। এসময় গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ৩৯টি নারী পাসেপোর্ট, ৬৬টি পাসপোর্টের ফটোকপি, ৩৬টি ভিসার ফটোকপি, ১৮টি বিমানের টিকিটের ফটোকপি, ১টি সিপিইও, ১৯টি মোবাইল উদ্ধার করে র‍্যাব। 

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাব-১১ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আলেপ উদ্দিন জানান, ইতিপূর্বে নারী পাচারকারী চক্রের ছয়জন র‍্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হওয়ায় আইন শৃংখলা রক্ষাকারি বাহিনীর নজর এড়াতে অন্যান্য সদস্যরা পাচারের কৌশল পরিবর্তন করে ফেলে। সরাসরি দুবাই ও মালয়েশিয়া পাচার না করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ আরো কয়েকটি দেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার শুরু করে তার। 

এই চক্রটি দেশের বিভিন্ন পোশাক কারখানার নিম্নবিত্ত সুন্দরী নারী শ্রমিক, তালাকপ্রাপ্ত ও পারিবারিক সমস্যার শিকার তরুণীদেরকে টার্গেট করে নাচ শিখিয়ে বিদেশে ডান্সবারে উচ্চ বেতনে চাকুরি দেবার নামে ফাঁদে ফেলে পাচার করে থাকে। 

এই পাচারের মূল হোতারা হচ্ছেন বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সির মালিক। তাদের সহায়তা করে থাকেন দেশের বিভিন্ন নাচের প্রশিক্ষণকেন্দ্র ডান্সক্লাবের মালিক ও প্রশিক্ষকরা। গত ২ বছরে এই চক্রটি পনের থেকে পঁচিশ বছর বয়সের সহস্রাধিক তরুণীকে বিদেশে পাচার করে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ ও প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত আসামী শাহাবুদ্দিন ধানসিড়ি ট্রাভেল এজেন্সির মালিক। ধানসিড়ি এজেন্সির মালিক শাহাবুদ্দিনের সাথে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের ড্যান্স বারের মালিকদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্য আসামীরা শাহাবুদ্দিন এর নারী সংগ্রহকারী এজেন্ট হিসেবে কাজ করত। 

তিনি জানান, সম্প্রতি র‍্যাবের গোয়েন্দ নজরদারিতে বিষয়টি ধরা পড়লে পাচারকারীদের অবস্থান শনাক্ত করে রবিবার রাতে অভিযান চালিয়ে আটজনকে গ্রেফতার ও তাদের হেফাজত থেকে পাচারের প্রক্রিয়াধীন দুই তরুণীকে উদ্ধার করা হয়। 

আলেপ উদ্দিন আরো জানান, গ্রেফতারকৃতরা প্রত্যেকেই পূর্বের একটি মামলার পলাতক আসামী। তাদেরকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। গ্রেফতারের পর তারা নারী পাচারের অভিযোগ স্বীকার করে র‍্যাবকে তারা এই সংক্রান্ত সব ধরণের তথ্য প্রদান করেছে।

উল্লেখ্য, গত ২৩ নভেম্বর দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো মোড়ের শাহ চন্দ্রপুরী রেস্টুরেন্ট থেকে এই চক্রের অনিক হোসেন (৩১), মো. মনির হোসেন ওরফে সোহাগ (৩০), আক্তার হোসেন (৪০), আফতাউল ইসলাম ওরফে পারভেজ (৩৭), আ. হান্নান (৫২) এবং মো. আকাশ (২৯) নামের ৬ জনকে আটক করেছিলো র‍্যাব-১১। 

এসময় বিদেশ পাচারের জন্য জড়ো করা ৪ তরুণীকে উদ্ধারসহ ৭০ টি পাসপোর্ট, ২শ টি পাসপোর্টের ফটোকপি, ৫০ টি বিমানের টিকেট, ৫০ টি ট্যুরিস্ট ভিসার ফটোকপি, ১ টি সিপিইউ, ১টি মনিটর এবং একটি অত্যাধুনিক বিলাসবহুল মাইক্রোবাস ও নগদ এক লাখ ৫৮ হাজার টাকা জব্দ করা হয়েছিলো। এ ধারাবাহিকতায় এবং আটকদের জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য অনুসারে ২৬ জানুয়ারি অভিযান চালায় র‍্যাব।

অপর একটি সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে কেবল নারায়ণগঞ্জ থেকে ৫ থেকে ৭শ সুন্দরী তরুণীকে দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে র‍্যাব সূত্র। তরুণীরা এয়াপোর্টে নামার সাথে সাথে পাচারকারী সিন্ডিকেটের সদস্যরা তাদের গ্রহণ করে হোটেলে নিয়ে গিয়ে গৃহবন্দি করে রাখতো। তারা নিজ ইচ্ছেয় বাইরে যেতে পারতো না। প্রাথমিক অবস্থায় এরা অসামাজিক কাজ করতে রাজি না হলে তাদেরকে নেশাজাতীয় দ্রব্য জোরপূর্বক প্রয়োগ করার মাধ্যমে দিনের পর দিন তাদের উপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হতো। বাধ্য করা হতো যৌন কাজে।

সারা দেশেই এই চক্রের অসংখ্য সদস্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরা ড্যান্স ক্লাবের প্রশিক্ষক ও ছাত্রদের মাধ্যমে সুন্দরী তুরণীদের ফেলতো ফাঁদে। বিদেশ যাওয়ার জন্য রাজি করিয়ে আন্তর্জাতিক নারী পাচারকারী চক্র তথা বিদেশে অবস্থানরত ড্যান্স বার মালিকের কাছ থেকে মাথা পিছু ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে কমিশন পেত স্থানীয় ড্যান্স ক্লাবের প্রশিক্ষক বা ছাত্ররা।


   আরও সংবাদ