ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ ভাদ্র ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

উইঘুর মুসলিম নির্যাতন নিয়ে ১৩৭ পৃষ্ঠার নথি ফাঁস


প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারী, ২০২০ ১৩:০০ অপরাহ্ন


উইঘুর মুসলিম নির্যাতন নিয়ে ১৩৭ পৃষ্ঠার নথি ফাঁস

   

 

আন্তজার্তিক ডেস্কঃ দাড়ি রাখা, বোরকা পরা, বিদেশ যাত্রার ইচ্ছায় পাসপোর্টের আবেদন কিংবা শুধু ইন্টারনেটে বিদেশি ওয়েবসাইট ব্রাউজিংয়ের কারণে চীন উইঘুরের অসংখ্য মুসলিমকে বিভিন্ন অন্তরীণ শিবিরে নিয়ে যায় বা আটকে রাখে বলে ‘ফাঁস হওয়া’ এক নথির বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।

বিবিসি বলছে, শিনজিয়াং প্রদেশের শিবিরগুলোতে লাখ লাখ মুসলমানের ভাগ্য কীভাবে নির্ধারিত হচ্ছে, সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত তাদের দেখা নথিটিকে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

নথিতে চীনের দূর পশ্চিমাঞ্চল শিনজিয়াংয়ের তিন হাজারেরও বেশি বাসিন্দার ব্যক্তিগত ও তাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণের বিস্তৃত তথ্য আছে।

১৩৭ পৃষ্ঠার এ নথিতে থাকা সারি ও কলামে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের প্রার্থনার সময়, ধরণ, কীভাবে তারা পোশাক পরেন, কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যদের আচরণ কেমন সেসবও লিপিবদ্ধ আছে।

গত বছর শিনজিয়াং থেকে ফাঁস হওয়া অত্যন্ত সংবেদনশীল বিভিন্ন নথি যেভাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও গণমাধ্যমের কাছে এসেছিল, ঠিক একইভাবে কিছু মানুষের ব্যক্তিগত ঝুঁকির ওপর ভিত্তি করেই এ নথিটিও ফাঁস হয় বলে বিবিসি জানিয়েছে।

কোনো সরকারি সিল বা চিহ্ন না থাকলেও নতুন এ নথিকে ‘আসল’ বলেই মনে করছেন শিনজিয়াংয়ে চীনের নীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, ওয়াশিংটনভিত্তিক ভিক্টিমস অব কমিউনিজম মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো ড. আদ্রিয়ান জেনজ।

“ধর্মীয় বিশ্বাসের চর্চার কারণে বেইজিং যে নির্যাতন করছে ও শাস্তি দিচ্ছে অসাধারণ এ নথি তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ হাজির করেছে,” বলেছেন তিনি। 

পশ্চিমা বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও দেশ দীর্ঘদিন ধরেই উইঘুরের মুসলমানদের ওপর চীনের নির্যাতন ও নিপীড়ন নিয়ে অভিযোগ করে আসছে।

বেইজিং শুরু থেকেই এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবেলায় তারা শিনজিয়াংয়ে কিছু বিশেষ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বানিয়েছে।

নথিতে উল্লেখ করা ‘চার নম্বর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি’কে শনাক্তও করতে পেরেছেন ড. জেনজ। গত বছরের মে মাসে চীনা কর্তৃপক্ষের আয়োজিত এক ভ্রমণে বিবিসির হয়ে যারা জিনজিয়াং গিয়েছিলেন, জেনজও তাদের মধ্যে ছিলেন।

বিবিসি বলছে, ফাঁস হওয়া নথির যেসব তথ্য তারা বের করতে পেরেছে, তার মধ্যে যেসব অংশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লংঘনের সম্ভাবনা রয়েছে, প্রকাশের পূর্বে সেসব আড়াল করে দেওয়া হয়েছে।

নথিতে দক্ষিণ শিনজিয়াংয়ের হুতার শহরের নিকটবর্তী কারাকাক্স এলাকার ৩১১ জনের অতীত তথ্য, তাদের ধর্ম চর্চা এবং আত্মীয়, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কের বিস্তারিত তথ্য আছে।

অন্তরীণ শিবিরে থাকাদের রাখা হবে নাকি ছেড়ে দেওয়া হবে এবং শিবির থেকে ছাড়া পাওয়াদের ফের নিয়ে আসা হবে কিনা, সে বিষয়ক সিদ্ধান্ত নথিটির একেবারে শেষ কলামে লেখা আছে; যাকে ‘রায়’ বলছে বিবিসি।

এসব কেন্দ্রকে চীন যে ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে; নতুন এ নথির তথ্য তার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক, বলছে বিবিসি।

নথির ৫৯৮ নম্বর সারিতে ৩৮ বছর বয়সী এক নারীর বিস্তারিত তথ্য আছে; কয়েক বছর আগে মুখমণ্ডল কাপড়ে ঢেকে চলাফেরার কারণে হেলসেম নামের ওই নারীকে চীনের এ তথাকথিত ‘পুনঃশিক্ষণ শিবিরে’ পাঠানো হয়েছিল।

‘বাস্তবিক অর্থে তেমন ঝুকিঁ নেই’ এমনটা লেখা থাকা সত্ত্বেও ৩৪ বছর বয়সী মেমেত্তোতিকে অন্তরীণ করা হয়েছে কেবল পাসপোর্টের আবেদন করায়। বেইজিং কর্তৃপক্ষ যে এখন শিনজিয়াং থেকে বিদেশ যাত্রার আকাঙ্ক্ষাকেও ‘উগ্রবাদের লক্ষণ’ হিসেবে দেখছে, মেমেত্তোতিকে আটক তার নজির, বলছে বিবিসি।

কাউকে কাউকে শিবিরগুলোতে নেওয়া হয়েছে ‘ঘন দাড়ি’ রাখায় কিংবা ধর্মীয় পাঠচক্র আয়োজনের কারণে। ২৩৯ নম্বর সারিতে থাকা নুরমেমেতকে পুনঃশিক্ষণ কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় ‘ওয়েবলিংকে ক্লিক করে নিজের অজান্তে বিদেশি একটি ওয়েবসাইটে চলে যাওয়ায়’। ২৮ বছর বয়সী এ যুবকের আচরণে অন্য কোনো সমস্যা নেই বলেও তাকে নিয়ে থাকা সারি ও কলামগুলোতে লেখা রয়েছে।

১৭৯, ৩১৫ ও ৩৪৫ এ বিপুল পরিমাণ ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে ৬৫ বছর বয়সী ইউসুফের। তার রেকর্ডে লেখা রয়েছে- ২০১৪ ও ২০১৫ সালে দুই মেয়ের নেকাব ও বোরকা পরা, ছেলের ইসলামী রাজনীতির প্রতি ঝোঁক এবং পরিবারের সদস্যদের ‘হানবিরোধী মনোভাবের’ কথা। রায়ের ঘরে লেখা রয়েছে- ‘প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখা’।

ইউসুফের এ  উদাহরণই বোঝাচ্ছে, কেবল নিজের আচরণ নয় এমনকী পরিবারের সদস্যদের যে কোনো ‘সন্দেহজনক’ আচরণের জন্যও উইঘুরের বাসিন্দাদের ‘শাস্তি পেতে হচ্ছে’।

যে ৩১১ জনের বিস্তৃত তথ্য রয়েছে, তাদের প্রত্যেকেরই অন্তত এক আত্মীয় নথিটি করার সময় বিদেশ ছিল বলে শিরোনাম দেখে নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসি। এতদিনে অন্তরীণ শিবিরগুলোতে থাকা ওই বাসিন্দাদের বেশিরভাগই ছাড়া পেয়ে গেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

তবে বিবিসির আশঙ্কা, সেখানে নিত্য নতুন অন্তর্ভুক্তি এবং নথিতে পুরনোদের ফিরিয়ে আনার চর্চার বিষয়টি উল্লেখ থাকায় সম্ভবত পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। ছেড়ে দেওয়ার পর তাদেরকে বিভিন্ন কারখানায় জোরপূর্বক শ্রম দিতে বাধ্য করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। 

২০১৭ সালের শুরুর দিকে ‘গ্রামভিত্তিক কাজের দল’ নামে পরিচিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা শিনজিয়াংয়ের মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর মানুষের ধর্মবিশ্বাস, চর্চা, আচার-আচরণ নিয়ে যে জরিপ করেছিল, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করেই বাসিন্দাদের পরবর্তীতে অন্তরীণ শিবিরে নিয়ে আসা হয় বলে নথির তথ্য দেখে অনুমান করা হচ্ছে।

ওই জরিপে, কার ঘরে কতগুলো কোরান, কাদের পোশাক কী রকম, কারা কত গভীরভাবে ধর্মচর্চা করেন সেসব তথ্য নেওয়া হয়েছিল। এগুলোই পরে শিনজিয়াংয়ের নজরদারি ও পুলিশিং সংক্রান্ত ব্যাপকতর তথ্যভাণ্ডার ইন্টিগ্রেটেড জয়েন্ট অপারেশনর প্ল্যাটফর্মে (আজেওপি) জমা হয় বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের।


   আরও সংবাদ