ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ ভাদ্র ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

চৌগাছায় শতাব্দী প্রাচীন পীর বলুহ (রহ) মেলা শুরু মঙ্গলবার


প্রকাশ: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ১৪:০০ অপরাহ্ন


চৌগাছায় শতাব্দী প্রাচীন পীর বলুহ (রহ) মেলা শুরু মঙ্গলবার

   

যশোর থেকে খান সাহেব : আগামীকাল মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) শুরু হচ্ছে যশোরের চৌগাছার ঐতিহ্যবাহী পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা। মেলা ঘিরে এলাকায় উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

মেলা পরিচালনা কমিটি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় পরিচালিত হবে। আগমীকাল আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলেও মেলার আসবাবপত্রের বেচাকেনা শুরু হয়ে গেছে আগে থেকেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবক কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আনছার-ভিডিপি সদস্যরা থাকবেন। এছাড়াও পুলিশের পক্ষ থেকে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মেলায় প্লাস্টিক, কাঠ ও স্ট্রিলের আসবাবপত্র, খেলনা, প্রসাধনী, গার্মেন্টস, হোটেল-বেকারি, মিষ্টির দোকান, নাগরদোলা, এ্যালুমিনিয়ামের সামগ্রী, ক্রোকারিজ, যাদু প্রদর্শনী, স্ট্রিলের নানা সামগ্রী, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ হাজারের অধিক দোকান বসেছে।

এছাড়াও কপোতাক্ষ নদে স্পিডবোর্ড চালানো, মৃত্যুকূপে প্রাইভেটকার ও মটরসাইকেল চালানোর মত বিনোদনের ব্যবস্থাও রয়েছে।

প্রতি বাংলাসনের ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) রওজা শরীফকে ঘিরে যশোরের চৌগাছা উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে বসে এই মেলা।

হাজরাখানা গ্রামে কপোতাক্ষ নদের পাশে উঁচু ঢিবির ওপর এ অঞ্চলের পীরে কামেল বলুহ দেওয়ান (রহ) এর রওজা শরীফ অবস্থিত। মেলার সময় এলে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পড়ে যায় ব্যস্ততার ধুম। এ অঞ্চলের কয়েকটি গ্রামে ঈদে-পূজায় না হলেও মেলা উপলক্ষে মেয়ে-জামাই দাওয়াত করার রেওয়াজ রয়েছে।

যাকে ঘিরে এই মেলা তার সম্পর্কে রয়েছে নানা মিথ। লোক মুখে প্রকাশ পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ‘তিনি যা বলতেন তাই হতো।’ তার জন্ম-মৃত্যুসহ জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ছিল রহস্যে ঘেরা। তিনি একই উপজেলার যাত্রাপুর গ্রামের ছুটি বিশ্বাসের ছেলে। তবে জন্মকাল সম্পর্কে আজও কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। জেষ্ঠ ভক্তদের মতে ‘তিনি ৩-৪ শ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন।’ 

তবে জেষ্ঠ সাংবাদিক নাসির হেলালের লেখা ‘যশোর জেলায় ইসলাম প্রচার ও প্রসার’ এবং সাংবাদিক মাসুদ পারভেজের লেখা ‘চৌগাছার পীর-দরবেশ’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় আনুমানিক ষোড়’শ শতাব্দির প্রথমদিকে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। 

গ্রন্থদুটি থেকে জানা যায় বলুহ (রহ) এর নামে ভারতের কলকাতা ও নদীয়া, বাংলাদেশের চৌগাছার হাজরাখানাসহ বিভিন্ন স্থানে ৫২টি থান (ইবাদতগাহ) আছে। যেখানে তার ভক্তরা বসে ইবাদত-বন্দেগি করেন। বর্তমানে উপজেলার জিওলগাড়ি, পার্শ্ববর্তী ঝিনাইদহ জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার বড়-ধোপাধী গ্রামে তার থানে ছোট পরিসরে মেলা বসে থাকে। তার নামে চৌগাছার হাজরাখানা পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) দাখিল মাদরাসার নামকরণ করা হয়েছে।

পীর বলুহ (রহ) সম্পর্কে মিথ প্রচলিত আছে, ‘যখন তাঁর বয়স ১০/১২ বছর তখন পিতার নির্দেশে গ্রামের পার্শ্ববর্তী মাঠে গরু চরাচ্ছিলেন। গরু দিয়ে ক্ষেত নষ্ট করার অভিযোগে ক্ষেতের মালিক গরুগুলি ধরতে গেলে তিনি সব গরু বক বানিয়ে বটগাছে বসিয়ে রাখেন।’ পিতার মৃত্যুর পর তিনি উপজেলার হাজরাখানা গ্রামে মামার বাড়িতে থেকে অন্যের জমিতে দিনমজুর খাটতেন। একদিন সরিষা মাড়াই করতে মাঠে গিয়ে সরিষার গাঁদায় আগুন ধরিয়ে দেন। সংবাদ শুনে গৃহস্থ মাঠে গিয়ে দেখে সরিষার গাঁদায় আগুন জ্বলছে। তখন গৃহস্থ রাগান্বিত হলে তিনি হেঁসে ছাই উড়িয়ে দেখিয়ে দেন শরিষা পোড়েনি।’

‘একদিন তার মামি খেঁজুর রসের চুলায় জ্বাল দিতে বললে তিনি জ্বালানির পরিবর্তে চুলায় পা ঢুকিয়ে আগুনে জ্বাল দিতে থাকেন। এতেও তাঁর পায়ের কোন ক্ষতি হয়নি।’ এমন অনেক অলৌকিক ঘটনার জন্ম দিতে থাকলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু মানুষ তাঁর নিকট এসে শিষ্যত্ব নেন। ‘অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলুহ দেওয়ান পীর আখ্যা পান।’

তার মৃত্যুর পর গ্রামাঞ্চলের মানুষ জটিল ও কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পেতে তাঁর নামে মানত করতে থাকে। মানত পরিশোধে প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার হাজরাখানা গ্রামে অবস্থিত তাঁর রওজা শরীফে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, নারকেল ও টাকাসহ নানা দ্রব্যাদি দিয়ে মানত শোধ করতে থাকে। 

সেখান থেকেই একসময় ভক্তদের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর প্রয়োজনে গড়ে ওঠে পীর বলুহ দেওয়ান (রহ) মেলা। দীর্ঘদিন থেকে স্বল্প পরিসরে মেলা হতে থাকলেও বিগত পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে জমজমাট মেলা। প্রতি ভাদ্র মাসের শেষ মঙ্গলবার মেলা শুরু হয়ে ৩ থেকে সাত দিন মেলার আনুষ্ঠানিকতা থাকলেও মেলা শুরুর ১৫/২০ দিন পূর্ব থেকে শেষের ১০/১২ দিন পর্যন্ত চলমান থাকে মেলার বেচাকেনা।

একসময় মেলায় বিশৃঙ্খলা ছিল নিয়মিত ঘটনা। ২০০২ সালে মেলায় ব্যাপক বোমাবাজি করে সন্ত্রাসীরা। সেসময় মেলায় কয়েকজন দোকানী ও দর্শনার্থী হতাহত হয়। 

অন্যদিকে ২০০৯ সালে মেলাচলাকালীন চৌগাছা শহরে উপজেলা আওয়ামী লীগের অফিসে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলা ও গুলিতে খুন হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সেসময়ের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক পাশাপোল ইউপি চেয়ারম্যান ইমামুল হাসান টুটুল। পরে প্রশাসনিকভাবে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ায় সে পরিবেশ পাল্টে গেছে। 

মেলায় সারা দেশ থেকে ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা আসেন ব্যবসা করতে। এ অঞ্চলের যশোর-ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা ও সাতক্ষীরা জেলার ২০/৩০ টি উপজেলার মানুষ আসেন মেলা দেখতে এবং মেলা থেকে আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয় করতে। কপোতাক্ষ নদের তীর থেকে হাজারাখানা পীর বলুহ দেওয়ান দাখিল মাদরাসা পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার বিস্তৃত এ মেলা আয়াতন ও পরিধিতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আরেক বিখ্যাত সাতক্ষীরার গুড়পুকুরিয়ার মেলা থেকেও বৃহৎ।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা এসএম হাবিবুর রহমানকে সভাপতি করে একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। 

চৌগাছা থানার ওসি রিফাত খান রাজীব বলেন, মেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। সেখানে একজন উপ-পরিদর্শকের (এসআই) নেতৃত্বে দশজন পুলিশ সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করবেন।


   আরও সংবাদ