ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ ভাদ্র ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

বন্দি থেকে মুক্তি পর্যন্ত কেমন ছিলেন শেখ মুজিব


প্রকাশ: ৮ জানুয়ারী, ২০২০ ১৩:০০ অপরাহ্ন


বন্দি থেকে মুক্তি পর্যন্ত কেমন ছিলেন শেখ মুজিব

   

বিশেষ প্রতিবেদন : আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। ৮ জানুয়ারি তিনি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন-দিল্লি হয়ে ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশে পৌঁছেছিলেন। ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখে মধ্যরাতে তথা ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাকরার অব্যবহিত পরেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন।

গ্রেফতারের পর থেকে মুক্তির আগ পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি ছিলেন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। এ সময়ে তাঁকে কঠিন অবস্থার মধ্যদিয়েঅতিক্রম করতে হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তাঁকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রধানতম বা পয়লা নম্বরের শত্রু ঘোষণা করে তাঁর বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় প্রহসনের বিচারের ব্যবস্থা করেছিল (লক্ষণীয়যে, এন্তার বিপ্লবী আর ঘোষক দাবিদারের উপস্থিতি   সত্ত্বেও সেদিন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী   প্রহসনের   বিচারে শেখ মুজিবের ফাঁসির ব্যবস্থা করেছিল)।

পাকিস্তানের নির্জন প্রান্তরের এক   নির্জনতম কারাপ্রকোষ্ঠে নিঃসঙ্গ সময় কেটেছে এসময়   তাঁর।  পৃথিবীর সাথেন্যূনতম সংযোগ ছিল না তাঁর। কোনো খবরাখবর পেতেন না তিনি। কী ঘটে যাচ্ছে তাঁর প্রিয় স্বদেশে, সে সম্পর্কে তাঁর সামান্যতম কোনোধারণা ছিল না বা সামান্যতম ধারণা পাওয়ারও কোনো সুযোগ তাঁর ছিল না। 

২৬ মার্চের পর থেকে ৮ জানুয়ারি মুক্তির আগ পর্যন্ত পাকিস্তানের ইতিহাসে ঘটে যাওয়া বা বাংলাদেশের বুকে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানতে পারেননি এবং   এমন অবস্থায় থেকেওতিনি এমন কোনো   পদক্ষেপ নিতে আদৌ আগ্রহী হননি যা   তাঁর মুক্তিকে ত্বরান্বিত করতে পারত বা কার্যত   বাংলাদেশের স্বাধীনতা ওপাকিস্তানের বিভাজনকে নস্যাৎ করে দিতে পারত। 

যে সময়টার কথা আমরাএখানে আলোচনা করছি সে সময়টার কথা বিশ্বের তাবৎ লেখনী একত্র করেও সঠিকভাবে কারো উপলব্ধিতে পৌঁছে দেয়া সম্ভব নয়। ঘটনার ঘনঘটায় সেদিন যারা উপস্থিত থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন (এমনকি বিপক্ষেও   যারা ছিল), পাকিস্তানের ভাঙন প্রক্রিয়া দেখছিলেন অবরুদ্ধ স্বদেশভূমিতে অথবা ভারতের মাটিতে আশ্রয়নিয়ে অথবা সদূর পাকিস্তানে আটকা পড়ে তারাও সেই দুঃসময়ে, অনেক সময়ে এই ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়তেন যে, কবে এই দুঃসময়ের অবসানঘটবে।

 অনেকে অধৈর্য হয়ে পাকিস্তানের ফাঁদে পা   দিয়েছে, অনেকে স্বাধীনতা আদৌ অর্জিত হবে কি-না, সন্দেহের দোলাচলে দুলেছেন। আর এই সব হয়েছে চোখের সামনে, ঘটনা ঘটে চলেছে দেখতে পেয়েও। এমনকি প্রবাসী সরকারের অন্যতম মন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র অথচ প্রভাবশালী গোষ্ঠী এসব সন্দেহ ও অধৈর্যকে পুঁজি করে, এমনকি শেখ মুজিবের   মুক্তির ইস্যুকে পুঁজি করে পাকিস্তানের সাথে   একটা সমঝোতায় পৌঁছা যায় কিনা সে মতে উদ্যোগী হয়েছিল। 

এই বৈরী অবস্থার ভেতর দিয়ে সমগ্র বাংলাদেশ   চলছিল। অন্যদিকে পাকিস্তানিনির্যাতন, নিপীড়ন, যুদ্ধাপরাধ সকল মাত্রা ছাড়িয়ে অব্যাহত গতিতেচলছিল। একটা সময় এমন হয়ে উঠেছিল  যে, অতি বড় আস্থাশীল ব্যক্তিও স্বাধীনতা যেন এক সদূরপরাহত বিষয় অথবা স্বাধীনতা যেন এক সোনার হরিণ। আর এ সবই হচ্ছিল উপস্থিত পক্ষ-বিপক্ষ উভয়েরই তখনকার উপলব্ধি। কিন্তু এই ঘটনার ঘনঘটা সম্পর্কে যিনি আদৌ কোনো কিছু জানা ছিলো না, তিনি কিন্তু মুহুর্তের জন্যও   জনগণের ওপর থেকে আস্থা হারাননি বা   স্বাধীনতার সম্ভবনা নিয়েও মনের অজান্তেও   সন্দিহান হননি। 

জনগণের উপর অবিচল আস্থা, স্বাধীনতার প্রশ্নে   আপোসহীন অঙ্গীকার, সংগ্রামের অজেয় চেতনা   তাঁকে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ফাঁসির রজ্জুর   হাত ছানির মধ্যেও বেঁচে থাকার অফুরান   সাহস জুগিয়ে ছিল। তিনি কখনো বিশ্বাস হারাননি। কখনো তিনি বিচলিত বোধ করেননি। তাঁর অমিত  সাহস তাঁকে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর প্রহসনের বিচারের রায়কে হাতের তুড়িতে উপেক্ষা করতে প্রেরণা দিয়েছে। 

পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তিকে তাই বঙ্গবন্ধু দেখেছেন ‘অন্ধকারথেকে আলোর পথের যাত্রা’ এবং ‘দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি’র অভিযাত্রা’হিসেবে। একজন মানুষ যিনি নির্জন প্রকোষ্ঠে নির্মম নিঃসঙ্গতায়সময় অতিক্রম করেছেন, ঘড়ির কাঁটার বহমানতা ছাড়া যাঁর জীবনে সময়তখন থমকে ছিল, স্বাধীনতার সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধের অবস্থা সম্পর্কেযিনি   কিছুই অবহিত হচ্ছিলেন না, স্বাধীনতার প্রশ্নে   সেই মানুষটির অবিচলতা আজকের দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বসে অনেক অর্বাচীনের ধারণায় নাও আসতে পারে। 

সেই সময়ের যারা সাক্ষী তাদের কেউ কেউ যখন এ নিয়ে নানা কথা বলতে চেষ্টা করেন, তখন আমরা যারা সক্রেটিসের সময়ের নই তারা সক্রেটিসের সময়ের অবস্থাটা অথবা মোনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের অবস্থানটা সহজেই হৃদয়ঙ্গমকরতে পারি। একটি   আন্দোলনের মধ্যমণি যখন তাঁর সকল   সহকর্মীকে নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে নিজে সে পথে না যেতে চান, তখন সহজেই তাঁর দুঃসাহসী সিদ্ধানের সুদূরপ্রসারী ভাবনা বুঝতে পারা যায়। 

একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা প্রকাশ্যে নানা ভাবে সেই ‘৭০-এর ঘূর্ণিঝাড়ের সময় হতে   সমগ্র বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ   করে  আসছিলেন, যিনি ৭ মার্চের বক্তৃতায় ‘ঘরে  ঘরে  দুর্গ গড়তে’ ‘ভাতে মারব পানিতে  মারব’ বলে
দেশবাসীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁর মতো একজন গণতান্ত্রিক   আন্দোলনের নেতা যখন একটি অখন্ড দেশকে দ্বিখন্ডত করে খন্ডত অংশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুতি নেন তখন তাঁকে নানা কৌশল এবং   আড়ালের আশ্রয় নিতে হয় এটাই স্বাভাবিক।

তাই সবকিছু বুঝেও যারা না-বোঝার ভান করে   সে সব অর্বাচীনদের অবিমৃশ্যকারিতা নিয়ে   আমরা তেমন একটা কথা বলতে চাই না।


   আরও সংবাদ