ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ ভাদ্র ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

ইতিহাসের খোজে জামদানি শাড়ি


প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারী, ২০২০ ১৩:০০ অপরাহ্ন


ইতিহাসের খোজে জামদানি শাড়ি

   


বিনোদন ডেস্কঃ জামদানী আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জামদানী শাড়ি।  কারিগর তার আবেগ আর অনুভূতির চাষাবাদ করেন সমস্ত শাড়ির জমিন আর পাড় জুড়ে।বিশ্বজুড়ে রয়েছে ঢাকাই জামদনীর সুনাম। বাঙ্গালী রমনী তো বটেই অনেক বৈদেশীরও এই শাড়ি ভালো লাগে।


রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কে বেঙ্গল শিল্পালয়ে চলছে জামদানি উৎসব। নিচে আর দোতলায় মিলিয়ে চলছে প্রদর্শনী।  তাঁতের আবহ পাওয়া যাবে মূল ফটক দিয়ে ঢোকার পরই।বাইরের বসার জায়গাতেই মাথার ওপর সাদা সুতা টানিয়ে রাখা হয়েছে, এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত। তাঁতে বোনার আগে এভাবেই সুতা টানা দিয়ে রাখা হয়, যাকে বলা হয় টানা হাঁটা

।এছাড়া  চারজন বয়নশিল্পী রয়েছেন,তারা বুনছেন শাড়ি আপন মনে।  যাতে দর্শনার্থীরা নিজের চোখে দেখতে পারেন কীভাবে তাঁতে তৈরি হয় জামদানি শাড়ি,তাই এই ব্যবস্থ। নিচতলার মূল প্রদর্শনী প্রাঙ্গনটি যেন এক জামদানি বিষয়ক তথ্য ভাণ্ডার। দুইতলার সমান উঁচু করে থরে থরে সাজানো বিভিন্ন জামদানি মোটিফের প্রিন্ট। এখানকার দেয়ালে আছে মুলত জামদানি নকশার ক্যাটালগ।

দেশ বিদেশের বিভিন্ন সংগ্রাহকের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা, জাদুঘর, নথি ইত্যাদি দেখে প্রাচীন আমলের জামদানির বিভিন্ন নকশার নমুনা সংগ্রহ করে দেশের বয়নশিল্পীদের দিয়ে পুনরায় কাপড়ের ক্যানভাসে তুলে আনা হয়েছে সেই নকশাগুলোকে।এদের মাঝে কয়েকটি প্রকৃত প্রাচীন জামদানির নিদর্শণও আছে। যেমন- কলকাতার উইভারস স্টুডিওর দর্শন শাহয়ের সংগ্রহশালা থেকে এখানে প্রদর্শন করা হয়েছে প্রায় দেড়শ বছরের পুরানো জামদানি শাড়ি।এরপরেই রয়েছে সুতা, শানা ও তাঁতের বিভিন্ন যন্ত্রাংশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ। তাকে সাজানো আছে মিল ও খাদি সুতা।


শূন্য কাউন্ট থেকে ৩শ’ কাউন্টের খাদি সুতা পাশাপাশি রাখা আছে। আর ঠিক তার নিচেই আছে ৪০/১ কাউন্ট থেকে ১০০/১ কাউন্টের মিলের সুতা।কাউন্ট যত বেশি, সুতা ততই মিহি। এর নিচের তাকে আছে তাঁতের যন্ত্রাংশ কান্টুস, মাকু ও নলি। পাশেই আছে শানা, সরু করে কাটা বাঁশের টুকরো। থরে থরে বসিয়ে তৈরি হয় শানা, যার প্রতিটির খাঁজে বসানো হয় সুতা। এখানে দেখা যাবে ২৭০০ শানা। যার মানে হল ২৭০০ লাইন সুতা পাশাপাশি বসিয়ে তার খাঁজে খাঁজে সুতা বসিয়ে বোনা হবে একটি শাড়ি।এরপরের  ঘরের দেয়ালে দেখা যাবে জামদানির প্রাচীন ইতিহাসের রূপরেখা। প্রাচীনকালের জামদানি বাণিজ্যের ধারা জানার পাশাপাশি পাওয়া  যাবে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের কোন এলাকাগুলোতে বয়নশিল্পী আজও এই জামদানিকে টিকিয়ে রেখেছেন তার খোঁজ।

 এছাড়া্রও জানা যাবে জামদানি বয়ন পদ্ধতির ধাপগুলো। কীভাবে সুতা থেকে শুরু হয়ে, দারুণ শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে তা শাড়িতে রূপ নেয়। এর পাশে আছে ‘ফিল্ম অ্যান্ড আর্কাইভ’ যেখানে রয়েছে বয়নশিল্পীদের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রা কেমন, কীভাবে তাঁতে কাপড় বোনা হয়। জামদানি নিয়ে দেশ বিদেশের বিভিন্ন লেখকের বইও আছে।

দোতলার মূল প্রদর্শণী প্রাঙ্গনেও আছে প্রাচীন উৎস থেকে সংগ্রহ করে আনা জামদানির নকশাগুলো দিয়ে তৈরি করা নতুন শাড়িগুলো। এই শাড়িগুলো সাজানোর কায়দাটাও আকর্ষণীয়, প্রতিটি শাড়ির নিচে আছে জামদানি শাড়ি তৈরি নিত্য ব্যবহার্য সুতা, শিমুল তুলা, নাটাই, খাঁচি ইত্যাদি অনুসঙ্গ ।  বিভিন্ন ধরনের মোটিফ একের পর এক সাজিয়ে, কয়েকটি মোটিফ একসঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই শাড়িগুলো।গতবাঁধা জামদানি নকশার বাইরের অনেক নকশা  দেখা যাবে এখানে।  প্রতিটি শাড়ির পাশে বর্ননা দেওয়া আছে যেমনঃ দুই বয়নশিল্পীর নাম, বয়নকাল, কত কাউন্টের কোন সুতা ব্যবহার হয়েছে এবং কোন প্রতিষ্ঠান সেটি তৈরি করিয়েছেন।

দেখা যাবে কাচের বাক্সে ঘেরা ১০০ থেকে ২০০ বছরের পুরানো জামদানি শাড়ি, অঙ্গরাখা পোশাক ইত্যাদি। দর্শন শাহ ছাড়াও বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের নির্বাহী সদস্য ও সাবেক সভাপতি রুবি গজনবী এবং কাশ্মিরের আশাফ আলির সংগ্রহশালা থেকে আনা হয়েছে এই শিল্পকর্মগুলো।

জামদানি বয়নশিল্পকে ইতোমধ্যে ২০১৩ সালে ইউনেস্কো ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ’-এর মর্যাদা ও স্বীকৃতি প্রদান করেছে। জামদানিই বাংলাদেশের প্রথম পণ্য, যা সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১৬ সালে ভৌগোলিক সূচক হিসেবে পরিগণিত হয়। বিস্ময়কর বয়নসৌকর্য বাংলাদেশের জামদানি বয়নশিল্পীদের দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও নৈপুণ্যের সাক্ষ্য বহন করে। দিন দিন একটি মূল্যবান ঐতিহ্য বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি জামদানির প্রকৃত রূপ সবার অগোচরে রয়ে যাচ্ছে। জামদানি বয়নশিল্প বাংলাদেশের ঐতিহ্যের মৌলিক, উৎকৃষ্ট ও অন্যতম অংশ।

বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ ও বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই জামদানি উৎসব চলবে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত।


   আরও সংবাদ