প্রকাশ: ১৩ অগাস্ট, ২০২০ ১৪:০০ অপরাহ্ন
মুফতি নূর মুহাম্মদ রাহমানী : আমল বিনাসী রোগ হিংসা। যে কয়টি আত্মিক রোগ মানব জীবনে অকল্যাণ ও বিপর্যয় ডেকে আনে বিশেষ করে মানুষের আমল ও পরকালীন জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তন্মধ্যে বিশেষ একটি রোগ হিংসা।
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এই মারাত্মক ব্যাধিটি। খুব কম সংখ্যক মানুষকেই পাওয়া যাবে হিংসা থেকে মুক্ত। অথচ হিংসা থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ। এর থেকে বেঁচে থাকা ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা যে এই ধংসাত্মক ব্যাধিটিতে জর্জরিত তা অনেক সময় টেরই পাই না।
সর্বপ্রথম হিংসাকারী হলো ইবলিশ। আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করে ঘোষণা করলেন, আমি তাঁকে পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব দান করব। আমার খলিফা বানাব। অতঃপর হজরত আদম (আ.)-কে এই মর্যাদা প্রদান করে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদেরকে নির্দেশ দিলেন আদমকে সেজদা কর। ইবলিশ এই নির্দেশ শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল এই ভেবে যে, এত বড় মর্যাদা তাকে প্রদান করা হল অথচ আমাকে প্রদান করা হলো না। যার ফলে সে আদম (আ.)-কে সেজদা করতে অস্বীকার করে বসল। সুতরাং সর্বপ্রথম হিংসাকারী প্রমাণিত হল শয়তান এবং সর্বপ্রথম অহংকারীও সে।
পবিত্র কোরআন ও হাদিসে হিংসা সম্পর্কে কঠিন হুঁশিয়ারবাণী উচ্চারিত হয়েছে। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে সাবধান থাক। কেননা হিংসা মানুষের পুণ্যসমূহ এভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন লাকড়িকে কিংবা শুকনো ঘাষকে খেয়ে ফেলে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯০৩)।
হিংসা এমন একটি ধ্বংসাত্মক ব্যাধি যে, মানুষের পরকালতো ধ্বংস করেই বরং ইহকালেও তা ধ্বংস ডেকে আনে। যে ব্যক্তি অন্যের প্রতি হিংসা করবে, সে সদা-সর্বদা মনোকষ্টে ভুগবে। কারণ যখনি সে অন্যের উন্নতি-অগ্রগতি দেখবে, তখন তার মনে কষ্ট ও দুশ্চিন্তা সৃষ্টি হবে। যার ফলে ধীরে ধীরে তার শরীর-স্বাস্থের অবনতি ঘটবে।
আল্লাহতায়ালা যদি স্বীয় অনুগ্রহে কাউকে আয়নার ন্যায় একটি মন দিয়ে থাকেন, যে মনে হিংসা নেই, বিদ্বেষ নেই, গীবত নেই, নেই শত্রুতা, তাহলে যদিও তার আমলনামায় অনেক বেশি নফল, অনেক বেশি জিকির-আযকার, অনেক বেশি তিলাওয়াত নাও থাকে, তথাপি আল্লাহতায়ালা তার মর্তবা এই পরিমাণ উঁচু করে দেবেন, যার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
হিংসা থেকে বাঁচতে মানুষের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি না দিয়ে নিজের অবস্থার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। অন্যের দোষ না দেখে নিজের দোষ দেখতে হবে। অন্যের সুযোগ-সুবিধার দিকে না তাকিয়ে সকাল থেকে সন্ধা পর্যন্ত আমার ওপর মহান আল্লাহর কত অসংখ্য অগণিত নিয়ামত বর্ষিত হচ্ছে এগুলো স্মরণ করা। মূল্যবান এই কথাটি সর্বদা স্মরণযোগ্য। ‘দুনিয়ার ব্যাপারে সর্বদা নিজ থেকে নিচু এবং নি¤œ পর্যায়ের লোকদের দেখ, আর দ্বীনের ব্যাপারে সর্বদা উচ্চ পর্যায়ের লোকদের দেখ।’
সবই আহকামুল হাকেমিন মহান আল্লাহর বণ্টন। তিনি স্বীয় হেকমত ও মানুষের মঙ্গলের জন্যই এরূপ বণ্টন রেখেছেন কাকে কতটুকু দেওয়ার দরকার তিনিই ভালো জানেন। তার বণ্টন রহস্য বুঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। আমাদের জ্ঞান-পরিধি সীমাবদ্ধ। পক্ষান্তরে আল্লাহ পাকের জ্ঞানের পরিধি পুরা জগতব্যাপী। এভাবে ভাবতে থাকলে হিংসা নামের ব্যাধিটি ধীরে ধীরে কমতে থাকবে আশা করা যায়।
হিংসার মূল কারণ কিন্তু দুনিয়ার মহব্বত এবং নেতৃত্বের মোহ। এ জন্য হিংসার গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা হলো দুনিয়ার মহব্বত এবং নেতৃত্বের মোহ দূর করার চেষ্টা করতে হবে। গভীরভাবে চিন্তা করবে যে, এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী। যে কোনো সময় চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ দুনিয়ার বিলাস-সামগ্রী আমার মুক্তির কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে না। দুনিয়ার সাময়িক স্বাদ, সাময়িক আনন্দ-উপভোগ, দুনিয়ার ধন-দৌলত, যশ খ্যাতি, সম্ভ্রব-মর্যাদা এ সবই যে অস্থায়ী। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেলেই সাঙ্গ হয়ে যাবে সকল খেলা। এরপর থাকবে না আর মুক্তির কোনো পথ। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ধ্বংসাত্মক ব্যাধি হিংসা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : মুহাদ্দিস জামিয়া আরাবিয়া দারুল উলূম
বাগে জান্নাত, চাষাড়া, নারায়ণগঞ্জ।