ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ ভাদ্র ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

দেশীয় পণ্যকে বহির্বিশ্বের সামনে তুলে ধরার স্বপ্ন দেখে জাবি শিক্ষার্থী মার্জিয়া


প্রকাশ: ১৭ অগাস্ট, ২০২০ ১৪:০০ অপরাহ্ন


দেশীয় পণ্যকে বহির্বিশ্বের সামনে তুলে ধরার স্বপ্ন দেখে জাবি শিক্ষার্থী মার্জিয়া

   

বিএন নিউজ : হিমালয় কন্যা পঞ্চগড়ের মেয়ে মার্জিয়া রহমান। জন্ম ও বেড়ে উঠা পঞ্চগড় শহরেই৷ বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক ৪র্থ বর্ষে অধ্যয়নরত রয়েছে। পড়ছে দর্শন নিয়ে।

পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের জ্ঞান ও গুণকে কাজে লাগিয়ে দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছে মার্জিয়া। মার্জিয়া তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প তুলে ধরেছেন সেরাদেশ অনলাইনের কাছে। 

স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে যা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এই তরুণ উদ্যোক্তা। কাছের মানুষ গুলো ছাড়া নিজের গল্পগুলো সবাইকে শোনানো হয়না। আপনার মাধ্যমে সবাইকে গল্প বলতে এলাম। অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করে হঠাৎ এসব কেন। আসলে আমার কাছে বিষয় টা হঠাৎ নয়। খুব ছোট বেলা থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনার হবার স্বপ্ন দেখি। 

এটাকেই আমি আমার পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলাম বরাবরই। কিন্তু পরিবারের সমর্থন পাইনি। খুব ছোট থেকেই নিজের স্বতন্ত্র একটা পরিচয়ের কথাই ভেবেছি। ভেবেছি একজন সফল উদ্যোক্তা হয়ে উঠবো একদিন। আসলে আর ১০ জনের মতো পড়াশোনা করে চাকুরী করতে আমি কখনোই চাইনি। 

আমি চেয়েছিলাম একটু অন্য কিছু করতে। আমি মনে করি যে কাজকে আমি ভালোবাসি সে কাজকে পেশা হিসেবে নিলে একঘেয়েমী বা বিরক্তের বিষয়টা আসেনা। পোশাক আর গয়না বানানোর প্রতি ঝোঁক আসে যেভাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন আমি টুকিটাকি নিজের পোশাক আর গয়না বানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করতাম। বন্ধুদের পোশাক ডিজাইন করে দিতাম। ফেসবুকের বন্ধু তালিকার অনেকে এবং সহপাঠীরা বলতে শুরু করলো তুই কেন এসব নিয়ে কাজ করছিস না? পুরোনো স্বপ্ন যেন মাথা চারা দিয়ে উঠলো। 

যেভাবে শুরু হলো "নাইওর"। খুব ছোট করে যাত্রা শুরু করলাম নাইওর কে নিয়ে। ভীষণ ছোট পরিসরে। নিজের জন্যে বানানো হাতের কাজের পোশাক নিয়ে প্রথমে শুরু করি কিন্তু পুঁজির অভাবে থেমে পড়ি। এরপর কিছু সময় পর গয়না নিয়ে কাজ শুরু করি। বেশ সাড়াও পাই। কিন্তু পরিবারের সমর্থনের অভাবে বার বার থেমে গেছি। 

বাবা মাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু লাভের খাতা শূন্য। তাতে আমি স্বপ্ন দেখা ছাড়িনি। মাথায় ছিলো একটা উক্তি-সামনে এগিয়ে যাও। কে কি বলছে–তাতে কান দিও না। নিজের ভালোর জন্য যা করতে হবে, করতে থাকো”– জনি ডেপ। আমার উদ্যোগের নাম কেন এবং কি নিয়ে কাজ করছি তা বলি। আমি তখন পেজের নাম খুঁজছিলাম। 

আমার ছোট বোন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়ে ওর মুখ থেকেই প্রথম বের হয় নাইওর। নাইওর শোনার পরপরই আমি বলে উঠলাম আরে এইতো পেয়েছি যথাযোগ্য নাম। গ্রাম বাংলার প্রচলিত নিয়মানুযায়ী বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে স্বীয় কন্যা অতিথি হয়ে আসাকে নাইওর বলে। বিয়ের পর বাবার বাড়িতে প্রথমবার আসাতে আবেগ, আকুলতা, টান, লজ্জা, প্রশান্তি সব জড়িয়ে থাকে। 

আমার নাইওর এমনি আবেগ, আকুলতা, টান, মায়ায় জড়নো। শিকড়ের টানে ফিরে আসার উচ্ছ্বাস আমার নাইওর। এই চিন্তা থেকেই নাইওর রাখা।এখন কাজ করছি হ্যান্ডপেইন্টেড, টাইডাই এবং হাতের কাজের দেশীয় পোশাক, গয়না, পাটের ব্যাগ, বাঁশের শৌখিন সামগ্রী নিয়ে। সামনে তাঁত, খাদি, গামছা ও জামদানী নিয়ে কাজ করতে চাই। নাইওর এর উদ্দেশ্য নিয়ে যা বলল মার্জিয়া আমি ভীষণ স্বপ্নবাজ। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। 

আমার উদ্দেশ্য বা স্বপ্ন অনেক বড়। আমি স্বপ্ন দেখি একদিন আমার নাইওর ব্রান্ড হবে যেখানে পোশাক পরিচ্ছদ, গহনা থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর সামগ্রী সব পাওয়া যাবে। আমি স্বপ্ন দেখি একজন সফল ফ্যাশন উদ্দোক্তা হবার, নিজের দেশকে বহির্বিশ্বের কাছে তুলে ধরার। দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি একদিন আন্তর্জাতিক কোন ফ্যাশনের অনুষ্ঠানে অন্যান্য নামীদামী ফ্যাশন হাউস গুলোর মডেলের সাথে একই র্যাম্পে হাঁটবে আমার ডিজাইন করা দেশীয় পোশাকের মডেল রা। 

দেশীয় পণ্য নিয়েই কাজ করে একজন সফল উদ্দোক্তা হতে চাই তা শুধু নিজের জন্যে নয় আরো বহু নারীর কর্মসংস্থান এর কারণ হতে চাই। আমি বিশ্বাস করি আমি একদিন পারবো ইনশাআল্লাহ। একা বড় হতে চায়না মার্জিয়া আমি অনেক বড় হতে চাই এটা সত্যি কিন্তু একা নয়। এই পথটা আমি একা যেতে চাইনা। আমি স্বপ্ন দেখি অনেক মানুষের কর্মসংস্থান নিয়ে। আমাদের দেশের মানুষেরা অনেক অভাবগ্রস্থ। উত্তরবঙ্গের আমার আশেপাশে দরিদ্র মানুষদের দেখি। বিশেষত এদের মধ্যে নারীদের অবস্থা শোচনীয় আমি দেশের এমন গরীব নারীদের কর্মসংস্থান এর কারণ হবার স্বপ্ন দেখি। 

আমার মাধ্যমে তারা সানন্দে বাঁচুক এই স্বপ্ন দেখি। নিজে লাখ টাকা জমিয়ে আলিসান জীবনযাপন করবো সে সাধ আমার নেই। তবে লাখো স্বপ্ন পূরণের সহায়ক হতে চাই।যদিও আমি খুব ধীরে পা ফেলছি কারণ আমার পরিবারের যেহেতু কোনো সমর্থন নেই তাই অর্থায়নেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তবে কনফুসিয়াস বলেছেন "তুমি কত ধীরে চলেছো সেটা কোন ব্যাপার নয়,না থেমে চলতে থাকাটাই আসল কথা। কতটুকু সফল নিজে কতটুকু সফল এটা যদি বলতে হয় তবে বলবো আমার কাছে নিজেকে সফল বলে দাবি করা মানেই থেমে যাওয়া। 

নিজের স্বপ্ন কে এগিয়ে নিয়ে চলতে থাকাই সফলতা। আর আমি চলা শুরু করেছি। আক্ষেপ এবং ভয়ের জায়গা ছিলো যা আক্ষেপ এবং ভয়ের জায়গা নিয়ে বলি আক্ষেপ হলো বাঙালী দেশি পণ্যের গুরুত্ব দিতে জানেনা। আরামদায়ক পোশাক অনেকেই খোঁজে কিন্তু সে অনুযায়ী বিনিময়মূল্য দিতে রাজি থাকেন না। আবার দেশী পণ্য নিয়ে জ্ঞানের বেশ অভাব তাই গুণাগুণ বিচারও করেন না। সবার উদ্দেশ্যে বলি দেশীয় পণ্য গুলো কে ভালোবাসুন। এগুলো সম্পর্কে জানুন। একটু দাম দিয়েই কিনুন। দেখবেন নিজেরাই নিজেদের উন্নতি করছেন। 

আরেক টা বিষয় হলো আমার প্রতিটি পণ্য নিজস্ব মেধা, সৃজনশীলতা, এবং আবেগ দিয়ে তৈরি কিন্তু অনেকেই সেটা হুবুহু কপি করে ফেলে। আবার পণ্যের মান খারাপ দিয়ে কম দাম দিয়ে ছেড়ে দেন যা ভীষণ ভোগায়। এবার আসি আরো একটা আক্ষেপে।আমার পরিবার আমার কাজের একদম বিরোধী। এতোটাই বিরোধী যে আমার তৈরি পণ্য, ডিজাইন নষ্ট করে ফেলে এমনকি আমাকে ক্যাম্পাসে না পাঠানোর হুমকিও দেন। 

আমার মনে হয় যদি বাবা মায়েরা সন্তানদের একটু বোঝেন এবং সমর্থন দেন তবে উপরে ওঠা অনেক সহজ হয়ে যায়। আর ইদানীং এতো এতো উদ্যোক্তা দেখে আমার ভীষণ ভয় হয়। হারিয়ে যাবার ভয়। স্বপ্ন খোঁয়া যাবার ভয় তবুও হেরে না যাবার তাঁড়নায় আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। 

ইনশাআল্লাহ খুঁটি শক্ত করে দাঁড়াবো সবার ভালোবাসা পেলে। জীবন হোক কর্মময়, নিরন্তর ছুটে চলা। চিরকাল বিশ্রাম নেয়ার জন্য তো কবর পড়েই আছে।


   আরও সংবাদ