প্রকাশ: ৭ অক্টোবর, ২০২০ ১৯:০০ অপরাহ্ন
হাবিবুল্লাহ : কবির কবিতার মতো, শিল্পীর কন্ঠে গাওয়া গানের চেয়েও মনোমুগ্ধকর, নয়নাভিরাম, সবুজের সমারহে বেড়ে ওঠা একটি গ্রামের নাম রুপনারায়নপুর।
নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার অন্তর্গত এ গ্রামে চোখের সামনে ধরা দেয় আঁকাবাঁকা নদীর দু'তীরে বিশাল সবুজে ভরা মাঠ। দক্ষিণা বাতাসে ঢেউ খেলানো সবুজের সাগরে ফসল ফলাতে উদয়াস্ত ব্যস্ত চাষী। খেয়াল করলেই নিশ্চিত ভাবে চোখে পড়বে চাষীদের এই কর্মব্যস্ততা। ফসলী জমিতে সার, কীটনাশক প্রয়োগের কাজও করছেন যাদের কেউ কেউ। ঘাম ঝরানো আমনের ফসল নিয়ে তাদের স্বপ্নের যেন কোনো শেষ নেই।
কৃষকের দিগন্ত জোড়া এই স্বপ্নের অংশীদার কৃষাণীরাও বটে। পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি চলে ফসল ঘরে তোলার। তারপর আসে নতুন ধান থেকে বাহারি সব পিঠা-পুলি তৈরির দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তবে এতে যেন ক্লান্তি নেই কৃষাণী'সহ কৃষক পরিবারের কারোরই।
রুপনারায়নপুর যেন প্রকৃতি মাতার নিজস্ব শৈল্পিকতার আঁচড়ে পরম মমতায় পটে আঁকা একটি ছবি। যার আঁকাবাঁকা মেঠোপথে হেঁটে যেতে যেতে মনে হবে স্বর্গের কোনো রাস্তায় হাঁটা পথিক আমি। বৃষ্টির স্বচ্ছ জলে ঝাঁক বেঁধে সাঁতার কাটতে থাকা পাতিহাঁস কিংবা রাজহাঁসের দল দেখে ক্ষণিকের জন্য হলেও স্থির হবে দৃষ্টি। সাদা হাঁসের শঙ্কাহীন প্যাঁক প্যাঁক শব্দে মন উদ্বেলিত হবে পথচারীর।
এ গ্রামের মানুষের ঘুম ভাঙে পাখ-পাখালির কিচিরমিচির শব্দে। কর্মব্যস্ত যান্ত্রিক শহরের মানুষের মতো এলার্মের শব্দে পরিচিত নয় তারা। কিংবা হয়তো সেই শব্দে ঘুম ভাঙানোর মতো তীব্র আকর্ষণ নেই তাদের। গ্রামের মানুষ গুলো প্রকৃতির খুব ঘনিষ্ঠতায় বসবাস করে বলেই হয়তো তারা প্রকৃতির মতোই শুভ্র এবং নির্মল। ভুবন ভুলানো হাসিতে সারাটা দিন গ্রামের বাতাস মাতিয়ে রাখে হাস্যোজ্জল দূরন্ত শিশুর দল। মাঠ পেরিয়ে, বনবাদাড়ে ঘুরেবেড়ানো এসব দূরন্ত শিশুদের ক্লান্তির সবটাই যেন ধুয়ে নিয়ে যায় গ্রামের পাশের বয়ে চলা ছোট্ট নদীর শ্রান্ত জলে।
কৃষকের কাছে আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে শরতের বৃষ্টি। রুপ-লাবণ্যে ভরা চিরযৌবনা এ শরৎ। শুভ্র মেঘ, কাশফুল, স্বচ্ছ নীলাকাশের অপূর্ব সংমিশ্রণে চমৎকার নকশা কাটে নদীর স্থির জলে। নদীর তীরে তীরে কাশফুল, গাছে গাছে হাসনাহেনা, কামিনী, বেলী আর বিলে-ঝিলে শাপলার সমারোহে গ্রাম ভরে ওঠে আশ্চর্য রুপমাধূরীতে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টি হৃদয়কে করে তোলে প্রফুল্ল। বৃষ্টি শেষে দিগন্তজুড়ে রংধনু মনের মাঝেও যেন আঁকিয়ে দেয় বাসন্তী রং। রোদেলা সকাল, রঙমাখানো সূর্যাস্ত, রাতের আকাশের পূর্ণ চাঁদ শরতকে পরিপূর্ণ করতে তার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় সহস্রগুণ।
শরতের হালকা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির দিনে দোকানের উঠানে বসে প্রবীণ পুরুষেরা গল্পের ছলে মাছ শিকারের জাল বুনে। নারী ও তরুণীদের দল হরেক রকমের নকশা করা বাহারি সব কাঁথা সেলাই ও সাংসারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। ক্ষেতের পাশেই ছোট ছোট পুকুর, ডোবা, খাল-বিল, নদী-নালায় মাছ ধরায় ব্যস্ত থাকে বাড়ন্ত ছেলেদের উৎসুক দল। এখানেই পুঁটি, শোল, বোয়াল, কই, মাগুরসহ নানা প্রজাতির মাছ ধরে তারা। বেলা শেষে খালুই ভর্তি করে ঠোঁটের কোণে বিজয়ীর হাসি নিয়ে ফিরে যায় বাড়ি।
আমার চোখে বসন্তের সাজে রুপনারায়নপুর আঠারোতে পা দেওয়া সদ্য এক কিশোরী। বৃক্ষের নতুন পাতায় ধরিত্রীপুরে যখন নবরূপায়ন, তখন মনে হয় ভীমা দেবী যেন সবটা সবুজ টিপ করে পড়িয়ে দিয়েছে রুপনারায়নপুরের কপালে। এ যেন নব্য প্রেমে পড়া প্রেমিকের চোখে স্পষ্টত প্রতীয়মান হওয়া প্রিয়তমার প্রতি তীব্র আকর্ষণ। তখন কল্পলোকের নন্দকাননের মতোই চোখ ধাঁধানো আলোকছটায় ফুলে ফুলে বর্ণিল হয়ে উঠে চতুর্পাশ। শিমুল, পলাশ, মহুয়া, কৃষ্ণচূড়া, বেলীসহ হাজরো ফুলে সাজে বসন্তের প্রেমময় প্রকৃতির সজ্জা। প্রেমিক মৌমাছি মধু আহরণের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করে সৌন্দর্যের ষোলো আনা।
তবে চির সবুজ যৌবনা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেরই কিছু কিছু নিজস্ব স্বকীয়তা রয়েছে। বেলী, কলমী, শিমুল, ঝুমকো, জবা, ঘাসফুল'সহ হাজারো প্রকৃতির ফুল গ্রামের আনাচে-কানাচে, ঝোপঝাড়ের শোভাবর্ধন করে আপন মহিমায়।
নীল আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায় শালিক, টিয়া, ডাহুক, মাছরাঙা, বক, কাঠ ঠোকড়া, কাক, কোকিল'সহ হাজারো প্রজাতির পাখি। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জলপাই, নারিকেল, সুপারী, তাল'সহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ আর লতাপাতার অকৃত্রিম ঘনিষ্ঠতায় গ্রামের মোহনীয়তাকে দিয়েছে পরিপূর্ণতা। গ্রামের বাঁশ ঝাড় কিংবা বট গাছের ছায়ায় বসে পাখির কিচির মিচিরের সাথে একটি লগ্ন আপনার হৃদয়কে নিজের অজান্তেই করে তুলবে প্রফুল্ল, মনোমুগ্ধকর। জাগিয়ে তুলবে হাজার বছর বাঁচার আশা। হারিয়ে যাবেন অন্য কোনো খেয়ালে যেথায় কেবই শুভ্র এবং নির্মলতার হাতছানি। আর এই হলো আমাদের রুপনারায়নপুর, ঠিক যেন প্রকৃতি প্রেমী কোনো শিল্পীর পটে আঁকা ছবির মতোই প্রাচুর্যে ভরা নওগাঁর শান্ত সুনিবিড় পল্লী।
হাবিবুল্লাহ
শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।