ঢাকা, শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ ফাল্গুন ১৪৩২, ৯ জ্বমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

বাংলাদেশের ইতিহাসে উপেক্ষিত ট্রাজিক দম্পতির গল্প!


প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর, ২০২০ ২০:০১ অপরাহ্ন


বাংলাদেশের ইতিহাসে উপেক্ষিত ট্রাজিক দম্পতির গল্প!

তরিকুল ইসলাম : সততা, প্রজ্ঞা, নির্লোভ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং নিরহংকার জীবনযাপনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরল ও উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তাজউদ্দীন আহমদ ও জোহরা তাজ দম্পতি। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অগ্রনায়ক হয়ে সবথেকে ফ্রন্টলাইনে থেকে দেশকে যেমন পথ দেখিয়েছিলেন তাজউদ্দীন, তেমনি তাঁর শক্তিশালী সঙ্গী হয়ে সাহস ও প্রেরণা যুগিয়েছিলেন জোহরা তাজ। তাজউদ্দীনের অটল ও অবিচল মনোভাবের পেছনে তাঁর ভূমিকা অপরিসীম, যার অনুপ্রেরণা থেকেই তাজউদ্দীন দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন।

"মুছে যাক আমার নাম, তবু থাকুক বাংলাদেশ "
মহান মুক্তিযুদ্ধে দুজনের আত্মাত্যাগ ও গৌরবের ইতিহাস আমরা সকলেই জানি, তবে ইতিহাসের একটু পেছনে ফিরে তাকানো যায়।

তাজউদ্দীন যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে পড়াকালীন সর্বকনিষ্ঠ নেতা হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে জনতার নেতা হয়ে উঠেছিলেন এবং ভাষা আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তেমনি জোহরা তাজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে পড়াকালীন উত্তাল সময়ের দিনগুলিতে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর দেখান। অর্থাৎ,  বাংলাদেশের জন্ম ও ভালো-মন্দের সাথে শুরু থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন জোহরা তাজ ও তাজউদ্দীন দম্পতি।

তাজউদ্দীন আহমদ ও জোহরা তাজ দম্পতি ছিলো অনুকরণীয় এবং সাধারণে অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
"সোনার গহনার বদলে খোঁপায় গোজা বেলিফুল ও সাদা শাড়িতে জোহরা তাজের সঙ্গে তাজউদ্দীনের বিবাহ সম্পূর্ণ হয়। "
ষাটের দশকে ময়মনসিংহ কারাগারে থাকাকালীন রাজবন্দী তাজউদ্দীন স্ত্রী জোহরা তাজকে উদ্দেশ্য করে চিঠিতে লেখেন, 
"সাধারণ, অসাধারণ, ছোট, বড়  কোন অভিজ্ঞতাই ফেলে দেবার নয়, সব অভিজ্ঞতাই জীবনের বিভিন্ন ফুলে গাঁথা মালা।"
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে মহান মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্যে  বাসা থেকে বের হওয়ার সময় স্ত্রী জোহরা তাজকে তাজউদ্দীন একটা চিরকুটে শুধুমাত্র লিখে গিয়েছিলেন, 

"যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে দেশ স্বাধীনের পরে।"
ভারতে অবস্থানকালে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যরা দেশপ্রেম থেকে উদ্ভুদ্ধ হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্মতা পোষণে ওয়াদা
(শপথ) করেছিল, দেশ স্বাধীন না হওয়া অবধি কেউ পরিবারেরে সাথে রাত্রি যাপন করবে না, তবে শেষ অবধি মন্ত্রী পরিষদের কেউ এই শপথ রক্ষা করতে না পারলেও তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ অবধি ঠিকই তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছিলেন এবং পরিবারের সঙ্গে একদিনের জন্যও থাকেননি।


 
"দুজনার দৃষ্টি বিনিময়ের সময়কালটা ছিল ১০-১৫ সেকেন্ড। অতি দ্রুত আরেকটু কাছে সরে এসে বললেন, "শোনো, আমি ৬-৭ মিনিট হাতে সময় নিয়ে এসেছি। এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমরা এক্সাইলে(নির্বাসনে) সরকার গঠন করেছি। আমি এবং ক্যাবিনেটের অন্য চারজন মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেছি যে দেশ পাকিস্তানি-সেনামুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমরা কেউ ফ্যামিলির সঙ্গে থাকবো না। আর একটা কথা, কালকেই এখান থেকে তোমাদের অন্য বাড়িতে সরিয়ে ফেলা হবে, কারণ এটা (সরকারি) অফিসারের বাসা" বলেই তিনি ঘড়ির দিকে দেখলেন।

এই সময়কালটা ছিলো ৫ থেকে ৬ মিনিট। সেই মুহুর্তগুলোতে এমন গৌরবমন্ডিত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে আমি(জোহরা তাজ) প্রাণভরে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম।প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে নয়,দারুণ শিহরণ জাগানো ঐক্যমত পোষণ করেছিলাম উদ্ভাসিত গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে। তিনি বুঝেছিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন।সেই সময়কার ঐ মহান সিদ্ধান্ত হাজার বছরের যেন এক অমূল্য উপাদান।"
  
(তথ্য- তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, শারমিন আহমদ) 
"৮ নম্বর থিয়েটার রোড(বর্তমান সেক্সপিয়র সরণি) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মূল কার্যালয়। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী 'মুজিবনগর' মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র। বিশাল গাছের আড়ালে আংশিক ঢাকা পুরনো আমলের ভবনটিতে আমরা প্রবেশ করলাম প্রবল উৎসুক ভরা হৃদয়ে। আম্মার সঙ্গে বারান্দা;হলঘর ও কড়িডোর অতিক্রম করে আব্বুর ঘরটিতে উঁকি দিয়ে দেখি তিনি ঘরে নেই। ঘরটি একাধারে আব্বুর অফিস, শয়নকক্ষ ও খাবারঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ঘরের মধ্যে নামমাত্র আসবাবপত্র। ঘরের একধারে একটি চিকন খাট বিছানো। অপর পাশে একটি টেবিলভর্তি একরাশ কাগজপত্র ও দুটি চেয়ার পাতা। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমে আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে শব্দ ভেসে আসছে। 

আম্মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঁকি দিতেই দেখেন যে আব্বু বাথরুমের মেঝেতে বসে একটি শার্ট কাচছেন।আব্বুর পরনে লুঙ্গি ও সাদা হাফহাতা গেঞ্জি।আমাদের সাড়া পেয়ে আব্বু ফিরে তাকাতেই দেখা গেলো যে তাঁর সাদা গেঞ্জির একাংশ রক্তে লাল হয়ে উঠেছে।ডায়াবেটিস রোগী আব্বুর বুকে একটি ফোড়া উঠছে এবং তা ফেটে যাওয়ায় এই অবস্থা। তাঁর শরীরেও বেশ জ্বর। আম্মার উদ্বিগ্ন ও দুঃখকাতর চেহারার দিকে তিনি ছুড়ে দিলেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ স্মিত হাসি। যেন এমন কোনো ব্যাপারই নয় এমন হালকা স্বরে বললেন,

"যে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সঙ্গে তাঁর আগামীকাল একটা কর্মসূচি রয়েছে। তাঁর আর শার্ট নেই। সে জন্য বাদামি রঙের ফুলহাতা একমাত্র  শার্টটিকে তিনি কেচে দিচ্ছেন যাতে শুকিয়ে পরদিন পরতে পারেন। " আমরা সকলেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আব্বুর মুখের দিকে। বাদামি রঙের ফুলহাতা  ঐ একমাত্র শার্টটি পরেই তিনি রণাঙ্গন, মুক্তিযুদ্ধাদের ক্যাম্প ও শরনার্থী শিবির পরিদর্শন করেন। এরপর আম্মা আব্বুর জন্য দুটি শার্ট কেনার ব্যবস্থা করলেন।"

(তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা, শারমিন আহমদ)
জাতির ক্রান্তিলগ্নে বার বার এই পরিবারকে আমারা বাংলাদেশের হাল ধরতে দেখেছি, সুস্থ রাজনীতির চর্চা ধারণ ও বহন করে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে দেখেছি।

১৯৭৫ এ বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের প্রয়াণের মধ্য দিয়ে যেমন আপোষহীন বন্ধুত্বের রূপায়ন আমরা দেখি, তেমনি বাংলাদেশের আকাশে দিশেহারা এক ভয়াল সময়ের ঘনঘটাও দেখি। ঠিক সে সময়ে,  

১৯৭৫ এর ১৫ই অগাস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মম ভাবে হত্যা হওয়ার পর এবং ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর দেশ ও জাতির দিশেহারা সময়ে,

 মহিয়সী নারী জোহরা তাজ ঝাঁপিয়ে পড়েন জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য আর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড গুলোর বিচারের দাবিতে বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে- টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ছুটে বেরিয়েছিলেন রাজিনীতি ও দেশকে সুসংগঠিত করতে।

শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে এই মহিয়সী নারীকে বলতে শোনা যায়।
"আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি, আমার সন্তানেরা এতিম হয়েছে কিন্তু জাতি হারিয়েছে বঙ্গবন্ধুকে আর জাতীয় চার নেতাকে, আমার ক্ষতির চেয়ে জাতির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেলো। আর তাই আজ আমি আমার রক্তে মাখা আঁচল নিয়ে আপনাদের কাছে বিচার দিয়ে গেলাম।"

জোহরা তাজউদ্দীনের সপ্তম মৃত্যু বার্ষিকীতে বাংলাদেশের ইতিহাসে উপেক্ষিত এই ট্রাজিক দম্পতির প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা! 

জোহরা তাজউদ্দীন (২৪ ডিসেম্বর ১৯৩২- ২০ ডিসেম্বর ২০১৩) 

বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


   আরও সংবাদ