ঢাকা, শুক্রবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ ফাল্গুন ১৪৩২, ৯ জ্বমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

নারীর বিচ্ছেদ অধিকার ও আইন


প্রকাশ: ১৫ মার্চ, ২০২১ ১১:৩৪ পূর্বাহ্ন


নারীর বিচ্ছেদ অধিকার ও আইন

শাহীন আলম : আমাদের দেশের নারীদের অধিকাংশই তাদের আইনি অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়। কিংবা সচেতন হলেও নানা ভাবে বাঁধার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। স্ত্রী কর্তৃক স্বামীকে তালাক প্রদান তেমনই একটি অধিকার। আইনের দৃষ্টিতে একজন স্বামীই যে কেবল তালাক প্রদান করতে পারবেন তা নয়; বরং ক্ষেত্রবিশেষে স্ত্রীও তালাক প্রদানের অধিকার রাখেন। এক্ষেত্রে যদিও স্বামীকে একচ্ছত্র অধিকার প্রদান করা হয়েছে তবে কিছু ক্ষেত্রে স্ত্রীও তালাক প্রদান করতে পারেন। তালাক-ই- তৌফিজ, খোলা তালাক এবং আদালতের মাধ্যমে স্ত্রীকে এই অধিকার প্রদান করা হয়েছে।

তালাক-ই-তৌফিজ স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে প্রদত্ত তালাক প্রদানের ক্ষমতা প্রদান। বিবাহ রেজিস্ট্রি তথা কাবিন নামার ১৮ নম্বর কলামে স্বামী নিজে স্ত্রীকে এই ক্ষমতা দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে স্ত্রীকে আদালতের দারস্ত হতে হয় না। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের নিয়ম অনুসারে তালাক ঘোষণার পর স্ত্রী যথাশীঘ্র সম্ভব স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর/সিটি মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ পাঠাবেন এবং স্বামীকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করবেন। 

নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন পর তালাক কার্যকর হবে। তাই কাবিন নামার ১৮ নম্বর কলামটি যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে পূরণ করা উচিত। কাজীর উচিত বর-কনেকে এসম্পর্কে অবগত করা। এটি পূরণ না করলে স্ত্রীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। এই ক্ষমতা না থাকলে স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নিতে হয়; যা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ও জটিল।

খোলা তালাক স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সম্মতিতে পারস্পরিক চুক্তির মাধ্যমে কাজী বা আদালতের নির্দেশে হয়ে থাকে। স্ত্রী স্বামীকে তালাকের প্রস্তাব দিয়ে থাকেন এবং স্বামী তাতে সম্মতি জানায়। এই পদ্ধতিতে স্বামী অনেক সময় তালাকের বিনিময়ে স্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিদান গ্রহণ করেন। তালাক-ই- তৌফিজ এর ন্যায় ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী প্রস্তাবক যেহেতু স্ত্রী নিজেই তাই তালাকের নোটিশ স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর/সিটি মেয়রকে কাছে স্ত্রীই পাঠাবেন।

তালাক-ই-তৌফিজ এবং খোলা তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ সম্ভব না হলে স্ত্রীকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে এবং ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের ধারা-২ অনসরণ করতে হবে। এই আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে একজন স্ত্রী কী কী কারণে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারবেন। তাই উপযুক্ত কারণ সাপেক্ষে স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতে তালাকের আবেদন করতে হবে এবং আদালতের ডিক্রিমূলে তা কার্যকর হবে।

তবে আমাদের সমাজে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা হলো স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় কিংবা আগে তালাকের নোটিশ পাঠায় তবে দেনমোহর পরিশোধ করতে হয় না। তাই অনেক ক্ষেত্রে স্বামী তালাক চাইলেও স্ত্রীকে আগে নোটিশ পাঠাতে বলেন। যা সম্পূর্ণ একটি ভুল ধারণা। কেননা স্ত্রী আগে তালাক দিলেও তার মোহরানা পরিশোধ করতেই হবে। এছাড়াও স্ত্রীকে যদি আগে ভরণপোষণ না দেওয়া হয় তবে সেই বকেয়া এবং ইদ্দতকালীন ভরণপোষণও প্রদান করতে হবে। এ সংক্রান্ত কোনো দাবিদাওয়া থাকলে স্ত্রী পারিবারিক আদালতেও যেতে পারবেন। 

স্ত্রী গর্ভবতী হলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত কোনো ভাবেই তালাক কার্যকর হবে না। এক্ষেত্রে নোটিশ পাঠানোর পরবর্তী নব্বই দিন এবং সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার মধ্যে যেদিনটি পরে হবে সেদিন থেকে তালাক কার্যকর হবে। তবে তালাক প্রদানের ক্ষেত্রে অবশ্যই বৈধ বিয়ে হতে হবে। সে জন্য প্রতিটি মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে বিয়ে ও তালাক রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক।

তবে হিন্দু আইনে সরাসরি বিবাহ বিচ্ছেদের কোনো বিধান নেই। কিন্তু, ভারতে ১৯৫৫ সালের হিন্দু বিবাহ আইনে কতিপয় বিশেষ ক্ষেত্রে আনীত অভিযোগ প্রমাণ সাপেক্ষে বিবাহবিচ্ছেদ সম্ভব হলেও বাংলাদেশে এ আইন প্রযোজ্য নয়। তাই স্ত্রী যদি একান্তই মনে করেন স্বামীর সঙ্গে বসবাস করা অসম্ভব তাহলে সে পিত্রালয়ে বা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে পৃথক থাকতে পারেন। এক্ষেত্রে স্ত্রী স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। 

১৯৪৬ সালে বিবাহিত নারীর পৃথক বাসস্থান এবং ভরণপোষণ আইন অনুযায়ী- এক স্ত্রীর বর্তমানে স্বামী অন্য স্ত্রী গ্রহণ করলে স্ত্রী স্বামীর থেকে পৃথক থাকলেও স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকবেন।

তবে খ্রিষ্টান বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ১৮৬৯ সালের ইংরেজ কর্তৃক প্রবর্তিত 'ক্রিশ্চিয়ান ডিভোর্স অ্যাক্ট' নামে একটি রাষ্ট্রী আইন রয়েছে। যদিও এ আইনে কোনো ক্যাথলিক খ্রীষ্টানের বিবাহ বিচ্ছেদ গ্রহণীয় নয়।

শাহীন আলম
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।


   আরও সংবাদ