প্রকাশ: ১৫ জুন, ২০২১ ০৯:৫৯ পূর্বাহ্ন
আবদুল হামিদ : নাম সুমি! স্বামীর থেকে পাওয়া নাম হাসান! আর এখন তাকে সবাই সুমি হাসান নামেই চিনে কিন্তু বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় তাদের ডিভোর্স হয়ে যায় কিন্তু স্বামীর দেওয়া নামটি তিনি এখনো ব্যবহার করেন। তাদের ঘরে দুটি সন্তানও আছে। হঠাৎ করেই এক সঙ্গে চলা ফেরার সঙ্গীদের হাতেই জীবন হারান সুমি হাসান। ২০১৮ সালের ১৮ জুন রাতে হত্যা করে। পরের দিন সকালে রাজধানীর নীলক্ষেত থানাধীন পূর্বাঞ্চল ৩০০ ফিট রাস্তার পাশের ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করে খিলক্ষেত থানা।
থানা থেকে ফোন আসে সিআইডির ক্রাইমসিন টিমে একটি ডেড বডি পাওয়াা গেছে লাশের ডিএনএ সংগ্রহ করতে হবে সিআইডিকে। আর এমন দায়িত্ব এসে পড়ে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) জাহাঙ্গীর হাসানের উপর কিন্তু তিনি অখুশি বা অসন্তুষ্ট নয় এর আগেও এমন অনেক ডেড বডির রিপোর্ট তাকে করতে হয়েছে। এমনকি কোন কুলুলেস হত্যা রহস্য উদঘাটন করতে পুলিশের এই কর্মকর্তার অনেকটাই আগ্রহী। তিনি এটা করবেন।
সিআইডির ক্রাইমসিন টিম নিয়ে অজ্ঞাতনামা মহিলার লাশের ছবি ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও বায়োলজিক্যাল এভিডেন্স সংগ্রহ করেন। আর এই ফিঙ্গারপ্রিন্ট এর মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অজ্ঞাতনামা লাশের পরিচয় শনাক্ত করা যায় পিতা- চাঁন মিয়া আর মাতা- আম্বিয়া খাতুন গোপালগঞ্জ কোটালীপাড়া। সিআইডি কুলুলেস মামলার তদন্তে শুরুর আগে ছুটতে থাকে বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে। কোনো তথ্য না মেলায় তারা ছুটছে কিন্তু ক্লান্ত হয়ে মামলার হল ছাড়ছে না সিআইডি। আর সুমির সবচেয়ে ভালো বন্ধু দিপ্তকে খুঁজতেই সিআইডি কেটে যায় কয়টা দিন। দিপ্ত থাকে রাজধানীর পান্থপথে তার সংসার আছে।
সিআইডি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগের টিম। রাজধানীর পান্থপথে এলাকায় এভাবেই বাসায় বাসায় বিদ্যুৎ সংযোগের টিমের নামে খুঁজতে শুরু করে সুমি হাসানের ভালো বন্ধুত্ব দীপ্তকেঅ আর এই দীপ্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে তার সম্পর্কে অনেক তথ্য। সে হত্যার সাথে জড়িত না থাকলেও যে তথ্য দিয়েছে তাতে সিআইডি তদন্তের জন্য সহজ হয়েছে অনেকটা পথ। এদিকে হত্যার রহস্য উদঘাটনে তিনি ছুটে চলেছেন গোপালগঞ্জ টুঙ্গিপাড়ায় যেখানে সুমি হাসানের শ্বশুরবাড়ি। নিজ এলাকায় অনেক খোজা খুজির পরে মেলে তার পরিচয়। কিন্তু হত্যার হওয়ার কারণ নিয়ে কোনো তথ্যই মেলেনি সেখান থেকে! তবে আশাহত নন তিনি। পাওয়া গেছে লাশের পরিচয় অন্তত বেওয়ারিশ দাফন করা লাগবে না লাশটিকে।
লাশ গ্রহণের জন্য পাওয়া গেছে অন্তত একটি পরিবারকে। এতেই খুশি এএসপি জাহাঙ্গীর কিন্তু হত্যার রহস্য উদঘাটনে তিনি মোরিয়া যেন রহস্য উদঘাটন তিনি করবেন। মামলার খোঁজখবর নেওয়া আর ছুটে চলা যেখানেই এ সম্বন্ধে কোন কিছু জানা যাচ্ছে সেখানে উপস্থিত টিম নিয়ে তিনি। শুরু হয় হত্যার রহস্য উদঘাটনে তৎপরতা সিআইডি টিম টুঙ্গিপাড়ায় রঙ্গিপাড়া খোঁজ খবর নিতে শুরু করেন ওখান থেকে অনেক কষ্টে পাওয়া যায় তার পরিচয়। আর তার প্রাক্তন স্বামী জাহিদ হাসানের মোবাইল নাম্বার এবং এলাকা থেকেই জানা যায় সে ঢাকার জিগাতলায় একটি মহিলার মেসে থাকে।
সিআইডি টিম ঢাকা জিগাতলা বিভিন্ন মহিলা দ্বারা পরিচালিত মেসে অভিযান শুরু করে। তিন থেকে চারদিন অভিযানের পর রাত ৪ টার দিকে পাওয়া যায় মৃতের প্রাক্তন স্বামী জাহিদ হাসানকে সে তার মৃত্যুর খবর শুনেছে। কিন্তু তার সাথে ডিভোর্স হওয়ার পরে আর কোন যোগাযোগ ছিল না বলে জানিয়েছে। তবে তার কাছ থেকে পাওয়া যায় তার পালিত মা আম্বিয়া খাতুনের ঠিকানা। এবার চলে হত্যারহস্য উদঘাটনে দ্বিতীয় ধাপ নিহত সুমি হাসানের পালিত মা আম্বিয়া খাতুন থাকেন ঢাকার মধ্যবাড্ডা আদর্শনগর একটি ভাড়া বাসায়। কিছুদিন সুমি হাসান তার কাছেই ছিল। তবে মৃত্যুর কয়েক মাস আগে সে উত্তরায় চলে যায় কাজের কথা বলে। কিন্তু আসলেই সে এতদিনে অসৎ পথে মাধ্যমে দেহ ব্যবসায় লিপ্ত হয়ে গেছে। এটা তার পালিত মা, প্রাক্তন স্বামী এবং তার প্রেমিক দীপ্ত জানে না। তবে তার মায়ের কাছ থেকে মিলে সুমির ফোন নাম্বার এবং সর্বশেষ অবস্থা এই নাম্বার পর্যালোচনা করে মিলে তার জীবনের সর্বশেষ তিনটি নাম্বার যে নাম্বারে তিনি সর্বশেষ যোগাযোগ করেছে। এরমধ্যে তার সিআইডি টিমের হাতে আসে উত্তরায় যে বাসায় থাকতো সুমি সেই বাসার তার রুম মেটের পরিচয় আর ফোন নম্বর। সেও একই পথের পথিক দেহ ব্যবসা তাদের কাজ।
সিআইডি এবার ছুটতে থাকে তার পিছনে বের করে তাকে। পরে মামলার শেষ ধাপে আসে সিআইডি টিম। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে মেলে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যা আরও সহজ করে দেয় অপরাধীদের ধরতে। জীবনের শেষ রাত সুমি হাসানের কেটেছে যে বাসায় সেই বাসায় নিয়ে যা তার রুমমেট এবং সে স্বীকার করে তাদের বাসায় হত্যার সাথে জড়িত ৩ জন আসা যাওয়া করত। আর টাকার বিনিময় তাদের সাথে শাররিক সম্পর্ক করে আসছিল। আর সেদিন রাতে সুমি হাসান তাদের বাসায় গেছিল। পরে সিআইডি টিম তার দেয়া তথ্য আর কল লিস্ট ধরে সর্বপ্রথম আটক করে ফখরুল ইসলাম (৪৩) কে তার অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পরেও সে শিকার হয় না সিআইডির কাছে। তবে সিআইডি নাসরবান্দা জানতে চাই আসলেই সুমি হাসানের সঙ্গে সেদিন কি হয়েছিল।
তবে বেশিক্ষণ আর সিআইডির সাথে মিথ্যা কথা বলে টিকতে পারেনি হত্যাকারী। পরে সবকিছুই বলে দেয় আসলেই সেদিন কি ঘটেছিল সুমি হাসানের সঙ্গে। পরে বাকি দুইটা নাম্বার ট্যাকিং ও তার দেয়া তথ্য ও ডিএনএ টেস্ট করে সবকিছু মিলে যায় সমান সমান। এবার সিআইডি জানতে চায় সেদিন রাত্রে আসলেই কি ঘটেছিল সুমি হাসানের সাথে সেটা। সবাই যখন ফাদে পরে আছে বলা ছাড়া রাস্তা নেই তাদের কাছে পরে অকপটে বলতে থাকে সুমি হাসানের হত্যাকারী ৩ পাষুণ্ড হৃদয়। তিন জনেরই সংসার বউ বাচ্চা আছে কিন্তু টাকার বিনিময়ে তারা সুমিকে রাত্রে কাছে নিতো।
আর সেদিন রাত্রে ও তারা সুমিকে কন্টাক করে বাসায় নিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করে। আর বাসাটা ছিল সালাউদ্দিন খলিফা সুমনের। সেদিন রাত্রি সুমি হাসানের সাথে তিনজনের একরাতের কন্টাক ৩০ হাজার টাকা কিন্তু তাদের কাছে এত টাকা ছিল না আর সুমিও নাছোড়বান্দা টাকা না নিয়ে সে তাদের বাসা থেকে বের হবে না আর এটাই হল সুমির জীবনের কাল। সুমি হাসান টাকা না পেয়ে তিনজনকে ব্লাকমিল করে! যে টাকা না দিলে তার সাথে শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি সে বলে দিবে তাদের পরিবারের সাথে আর এতেই তিনজনের বিপত্তি।
কারণ সবারই আলাদা আলাদা পরিবার আছে। আছে বউ বাচ্চা। তখন কোন দিশা না পেয়ে তিনজনেই পরিকল্পনা করে সুমি হাসানের জীবন প্রদীপ নিভে দিতে হবে আর সেই পরিকল্পনা মতোই কাজ করে তারা। এতে টাকাও দিতে হবে না আর কোন ঝামেলাও থাকবে না। কিন্তু তারা ভাবেনি যে সিআইডি তো আর থেমে থাকবে না তাদের কাজ অপরাধীকে গভীর থেকে ট্রেনে দিবালোকে নিয়ে আসা।
অর্বশেষে ফারুক ইসলাম (৪৩) কাজি ইমরান মাহমুদ (৩২) ও সালাউদ্দিন খলিফার সুমন (৩৮) নামেই হত্যা মামলার পুরো চার্জশিট দাখিল করেছে সিআইডি হত্যা ২০২০ সালে ১৯ জুন হলেও ২০২১ সালে ১৫ জুন মামলার চার্জশিট জমা দিল সিআইডি। সিআইডি ক্রাইমসিন ইউনিটের তদন্তাধীন মামলার আরেকটি সাফল্য। আর এভাবেই সিআইডি বের করে নিয়ে আসছে কুলুলেস হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য যা আসলেই হতবাক তারা নিজেরাও কিভাবে সম্ভব এভাবে হত্যা করা আর লাশ গুম করা।