ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ১৫ ফাল্গুন ১৪৩২, ৮ জ্বমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

'বিচার বিভাগের অর্থবহ স্বাধীনতা কি অধরাই থেকে যাবে'


প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর, ২০২৫ ০৯:৫৬ পূর্বাহ্ন


'বিচার বিভাগের অর্থবহ স্বাধীনতা কি অধরাই থেকে যাবে'

শহীদুল হক: সম্প্রতি বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ অত্যন্ত স্বস্তির ও একই সাথে আনন্দের। কারণ, বিগত শাসনামলে আইনমন্ত্রী এবং তার ছায়াতলে থাকা আইনসচিবসহ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত প্রভাবশালী বিচারক নেতাদের যোগসাজশের কারণে বিচার বিভাগকে খুব সহজেই রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা যেতো। তবে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, গত ২৮ জুলাই ২০২৫ তারিখে অনেকটা সর্বসাধারণের অগোচরে জারি করা দুটি বিধিমালায় আইন মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব হতে আইনসচিব পর্যন্ত পদসমূহ (যার সবগুলোই নির্বাহী বিভাগের পদ) ন্যাক্কারজনকভাবে জুডিশিয়াল সার্ভিসের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে; যা বিগত সরকারের সময় চলা জুডিশিয়াল এনার্কি’র মধ্যেও করা সম্ভব হয়নি।

আওয়ামী সরকারের সময়ে ২০০৭ সালে জারি করা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস সংক্রান্ত একটি বিধিমালার উপবিধি-৭(১) পরবর্তীতে সংশোধন করে সেটিকে পুঁজি করে জুডিশিয়াল সার্ভিসের বিচারকগণকে এতদিন ধরে নির্বাহী বিভাগে পোস্টিং দেয়ার কাজটি করা হচ্ছিল। এই দুটি বিধিমালা জারির পর এখন আর সেটিরও প্রয়োজন হবে না, সরাসরি বিচারকদের নির্বাহী বিভাগে পদায়ন করা যাবে।

এ সকল বিধান স্পষ্টত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের ১ নম্বর নির্দেশনার লংঘন এবং পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য: বিচার বিভাগের অর্থবহ স্বাধীনতা ও কার্যকর পৃথকীকরণ নিশ্চিত করার পথে অন্যতম অন্তরায়। শোনা যায়, বর্তমান আইন উপদেষ্টাকে ‘ম্যানেজ’ করে আইন মন্ত্রণালয়ে থাকা প্রভাবশালী বিচারকগণ এ কাজ করেছেন। সূত্রের মাধ্যমে জানা যায়, সদ্য সাবেক জনপ্রশাসন সচিব ও বিধি শাখার কর্মকর্তাদের আদালতে দাঁড় করিয়ে রাখা এবং চাকরির ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে জনপ্রশাসনের বিধি শাখার সম্মতি আদায় করা হয়েছে।

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী বিভাগের পরিধিভুক্ত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়। সচিবসহ উক্ত মন্ত্রণালয়ের সকল পদ নির্বাহী/প্রশাসনিক পদ। বিচার-কর্মবিভাগ (জুডিশিয়াল সার্ভিস) নির্বাহী বিভাগ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি কর্মবিভাগ। সহকারী জজ হতে জেলা জজ এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/সমমানের বিচারিক পদসমূহ সমন্বয়ে বিচার-কর্মবিভাগ গঠিত। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা নির্বাহী বিভাগের আওতাধীন কোনো প্রশাসনিক পদকে বিচার-কর্মবিভাগের সদস্যদের জন্য সংরক্ষণযোগ্য ঘোষণা করার সুযোগ নেই। জনৈক কাজী আব্দুল হান্নান ২০০৭ সালের বিধিমালার উপবিধি-৭(১) অসাংবিধানিক এবং মাসদার হোসেন মামলার রায় পরিপন্থি উল্লেখ করে তা বাতিল চেয়ে মহামান্য হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন- ১০১৫৯/২০০৭ দায়ের করেন। মামলাটি দায়েরের পর দীর্ঘদিন কোনো শুনানি হয়নি, অত:পর ২০১৭ সনে কয়েক দফা শুনানির পর সংশ্লিষ্ট বেঞ্চ ভেঙ্গে দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে তা আর কার্য-তালিকায় আসেনি, মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। শোনা যায়, তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাড. কামরুল ইসলামের হস্তক্ষেপে মামলাটিকে ‘ডিপ ফ্রিজে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

পরিতাপের বিষয়, ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয়ের পরও এই অসামন্জস্যপূর্ণ বিধানকে পুনঃবৈধতা প্রদানের মাধ্যমে হাস্যকরভাবে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী/প্রশাসনিক পদ, তথা মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব, সিনিয়র সহকারী সচিব, উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদ-কে বিচার বিভাগের তফসিলভুক্ত পদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর বিচার কর্ম-বিভাগের সার্ভিস প্রশাসন তথা বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ইত্যাদি যখন উক্ত সচিবালয় থেকে পরিচালিত হবে, তখন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের আইন মন্ত্রণালয়ে থাকার ন্যূনতম যৌক্তিকতাও অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। তদুপরি, রুলস অফ বিজনেস, ১৯৯৬ অনুসারে সচিবালয়ের প্রশাসনিক পদসমূহের প্রশাসন-ব্যবস্থাপনার এখতিয়ার সরকার প্রধানের নেতৃত্বে পরিচালিত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের; বিচার কর্ম-বিভাগের বা আইন মন্ত্রণালয়ের নয়। 

সচিবালয়ের সংগঠন এবং কার্যবিধিমালার বিষয়ে সংবিধানের অধীন জারীকৃত রুলস অফ বিজনেস–ই সর্বোচ্চ আইন। এই বিষয়ে রুলস অফ বিজনেস–এর সাথে সাংঘর্ষিক কোন লিগ্যাল ইন্সট্রুমেন্ট জারির সুযোগ নেই। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালে জুডিশিয়াল সার্ভিস সচিবালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত একটা খসড়া অধ্যাদেশ উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অনুমোদন হয়, যেখানে নির্বাহী বিভাগের পদে জুডিশিয়াল অফিসারদের নিয়োগের এসকল আজগুবি কোন বিধান ছিলনা। কিন্তু অজানা কোন কারণে সেটি জারি হয়নি এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে অধ্যাদেশটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

আইন মন্ত্রণালয় থেকে যেহেতু এখনো জুডিশিয়াল অফিসারদের বদলি পোস্টিং এর অর্ডার হয় (যা হওয়া উচিত নয়, এগুলো সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রারের দপ্তর থেকে হওয়া উচিত) সেহেতু সংবিধানসম্মত না হলেও বা মাসদার হোসেন মামলার পরিপন্থি হলেও আইন সচিব বা বিচার শাখার পদগুলোতে বিচারকদের সাময়িকভাবে থাকার যৌক্তিকতা দেখানো হয়। কিন্তু বিচারকদের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পর বিচার কর্ম-বিভাগের সার্ভিস প্রশাসনের কাজগুলো যখন উক্ত সচিবালয় থেকে পরিচালিত হবে, তখন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের আইন মন্ত্রণালয়ে থাকার ন্যূনতম যৌক্তিকতাও নেই।

আরও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে: পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে বিলম্বিত করে- এই ফাঁকে সেই সমস্ত বিধানকে শক্তিশালী করা হচ্ছে, যে বিধানগুলো ব্যবহার করে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার পরেও বিচারকগণ আগের মত আইনমন্ত্রীর ছায়াতলে থেকে খবরদারি করতে পারবেন। আসল কথা হচ্ছে, জুডিশিয়াল সার্ভিসের নেতৃস্থানীয় বিচারকরা অধস্তন আদালতে প্রভাব বিস্তার এবং ঢাকা শহরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ লোভনীয় বিবেচিত কতিপয় নির্বাহী পদ আঁকড়ে থাকার জন্য এগুলো করছেন। সাব-রেজিস্টারদের প্রধান আইজিআর পদে কিংবা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি পদে বিচারকদের কী কাজ?

আইন মন্ত্রণালয়ে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগের কোন অপরিহার্যতা নেই। আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইং এবং মতামত উইং এর যেসব পদে আইন ডিগ্রিধারী কর্মকর্তার প্রয়োজন রয়েছে বলে বিবেচনা করা হয়, তার সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ১২। এসব পদে কাজ করার মত পর্যাপ্ত সংখ্যক আইন ডিগ্রিধারী নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তা রয়েছেন। বিভিন্ন ক্যাডার এবং লেজিসলেটিভ সার্ভিস মিলিয়ে প্রায় ৮৫০ জন আইন ডিগ্রিধারী কর্মকর্তা রয়েছে। শুধু প্রশাসন ক্যাডারেই সহকারী সচিব হতে সচিব পদমর্যাদার ১৮৯ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন ডিগ্রিধারী কর্মকর্তা রয়েছেন। মাসদার হোসেন মামলার অথর জজ প্রাক্তন মাননীয় প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল আফসোস করে একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন "আমরা চেয়েছিলাম তেল ও পানিকে এক সঙ্গে যাতে মিশ্রিত করা না হয়। 

আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সার্ভিসের সদস্যদের জন্য যদি এত দিন কোন সংরক্ষিত পদ থাকত, তাহলে এই রায়ের পরে সম্পূর্ণ নতুন চিন্তা চেতনার আলোকে তারা সার্ভিসের বাইরের লোককে ঢোকানোর ব্যবস্থা করতেন। কথা হচ্ছে, তাদের এই ২০০ বছরের পুরোনো মানোবৃত্তি থাকবে কেন? ওসব তো পুরোপুরি নির্বাহী পদ, ওখানে জুডিশিয়াল সার্ভিসের লোক ঢুকবেন কেন? বিচারকদের দিয়ে নির্বাহী বিভাগের কাজ করানো কোনভাবেই ঠিক নয়। যেখানে আধা বিচার বিভাগীয় কাজ আছে সেখানে দিতে পারেন, কিন্তু অন্য মন্ত্রণালয়ে বা আইন মন্ত্রণালয়ে এদের সংরক্ষিত পদে রাখা বা ঢোকানো বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী।’

ফলে, বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথকীকরণ, অর্থবহ স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ এবং জুডিশিয়াল সার্ভিসের স্বাতন্ত্র্য ও মান-মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য অধস্তন আদালতের বিজ্ঞ বিচারকগণকে নির্বাহী বিভাগের সাথে মিশ্রণ/পদায়নের অসাংবিধানিক ব্যবস্থার দ্রুত অবসান আবশ্যক। এটি বোঝার জন্য খুব বেশি বিদ্যা-বুদ্ধি লাগে না যে, জনমত ও জনস্বার্থ উপেক্ষা করে শুধুমাত্র বিশেষ কোন গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য সরকারের নির্বাহী বিভাগের পদ বিচার বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে যা দেশবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ! 

হাজার শহিদের রক্তের বিনিময়ে গঠিত এ সরকারে কার্যকালে জুডিশিয়াল সার্ভিসের বিজ্ঞ বিচারকদের নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন পদে নিয়োগের সুযোগ রাখার নাম কি সংস্কার? নাকি এর মাধ্যমে অদূর ভবিষ্যতে জুডিশিয়াল ক্যু’র সুপ্ত বীজ বপন করে রাখা হলো? আফসোস!

-শহীদুল হক
প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক


   আরও সংবাদ