প্রকাশ: ১০ মার্চ, ২০২১ ০৩:০৬ পূর্বাহ্ন
কূটনৈতিক প্রতিবেদক : বাংলাদেশ দূতাবাস, প্যারিস এবং ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে আজ তৃতীয় ও শেষ দিনে ইউনেস্কো ও ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন-এর যৌথ আয়োজনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ: একটি ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ শীর্ষক ওয়েবিনার অনুষ্ঠিত হয়।
এ ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে ইউনেস্কো-এর সামাজিক ও মানবিক সেক্টরের সহকারী মহাপরিচালক মিসেস গ্যাব্রিয়েলা রামোস, ইউনেস্কো-এর কমিউনিকেশন এবং ইনফরমেশন সেক্টরের স্ট্রাটেজিস এন্ড পলিসিজ বিষয়ক পরিচালক মিঃ গাই বার্গার অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য প্রদান করেন।
ওয়েবিনারে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবং বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালস-এর বঙ্গবন্ধু চেয়ার প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ইন্সটিটিউট জাতীয় ডেস ল্যাঙ্গুয়েজ এবং সভ্যতা প্রাচ্য (ইনালকো) এর বাংলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. ফিলিপ বেনোইট এবং মিডিয়া আর্কাইভ বিশেষজ্ঞ এবং ইউনেস্কো-এর মেমোরি অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারের বাছাই উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য শ্রীমতি ডমিনিক সেন্টভিলে। এ অনুষ্ঠানে সঞ্চালক ছিলেন ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি কাজী ইমতিয়াজ হোসেন।
রাষ্ট্রদূত কাজী ইমতিয়াজ হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। রাষ্ট্রদূত তাঁর স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ২০২১ সালে বাংলাদেশ তিনটি মাইলফলক উদযাপন করছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী, বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী এবং ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ-এর ৫০তম বর্ষপূর্তি। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন, দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই আমরা আমাদের জন্মভূমি পেয়েছি। এ স্বাধিকার আন্দোলনে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের গুরুত্ব অপরিসীম বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অনলাইন এ আয়োজনের উদ্বোধনী পর্বে বাংলাদেশের মাননীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ.কে. আব্দুল মোমেন, এম.পি-এঁর একটি শুভেচ্ছা ভিডিও বার্তা প্রদর্শিত হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে সম্পৃক্ত হওয়া এবং অতি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর নামে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে এ মহান ব্যক্তির প্রতি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য ইউনেস্কোকে তিনি ধন্যবাদ জানান।
তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ অভিন্ন, বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ হত না। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক-ই দেননি, বরং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের রূপরেখা প্রদান করেছেন।
শুভেচ্ছা বক্তব্যে ইউনেস্কো-এর সামাজিক ও মানবিক সেক্টরের সহকারী মহাপরিচালক মিসেস গ্যাব্রিয়েলা রামোস বলেন, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ উদযাপন শুধু বাংলাদেশের নয় ইউনেস্কোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বিষয় যে ভাবে উঠে এসেছে তা ইউনেস্কো-এর আদর্শ ও লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে তিনি সৃজনশীল অর্থনীতিতে ইউনেস্কো-বঙ্গবন্ধু পুরস্কার প্রবর্তনে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এ পুরস্কার অভিবাসী, নারী-পুরুষ সমতা ও যুব উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মিঃ গাই বার্গার বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণ শুধুমাত্র বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক নেতার মুখ নিঃসৃত কিছু শব্দ নয়, বরং অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বঞ্চনার শিকার একটি জাতির এক সংগ্রামী নেতার সংগ্রামী জীবনের বহিঃপ্রকাশ। ইউনেস্কো-এর বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার জন্য যে বৈশিষ্ট্যসমূহ থাকা দরকার তার সব গুলোই এ ভাষণে বিদ্যমান বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন।
তাই অনুবাদের মাধ্যমে এ ভাষণের প্রচার ও প্রসারে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের জন্য তিনি ধন্যবাদ জানান এবং জাতিসংঘের ৬টি দাপ্তরিক ভাষাসহ সর্বমোট ১৪ টি ভাষায় অনুদিত হলেও আরো অধিক ভাষায় অনুবাদের মাধ্যমে এ ভাষণ বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারে তিনি মত প্রকাশ করেন।
এরপর এক ঘন্টা ব্যাপী প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনায় প্রথম বক্তা হিসেবে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ প্রফেসর ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এ ভাষণের বিষয়বস্তু নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এ ছাড়া এ ভাষণের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক গুরুত্ব ও কৌশলসমূহ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, এ ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যথার্থভাবে পারিপার্শ্বিকতা বিচার করে সুকৌশলে মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
প্রফেসর ড. ফিলিপ বেনোইট এ ভাষণের বৈশ্বিক আবেদন তুলে ধরেন এবং ইউরোপীয় ও প্রাচ্যের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এ ভাষণের তথা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্বের বিভিন্ন দিকের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি বাগ্মিতার দৃষ্টিকোণ থেকে বঙ্গবন্ধুকে উপমহাদেশের অতুলনীয় নেতা হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ফরাসি ভাষায় অনুবাদের অভিজ্ঞতা হিসেবে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেন এ ভাষণ বঙ্গবন্ধুর বাগ্মিতার কারণে অন্যান্য ভাষাভাষীর কাছেও সমভাবে আস্বাদিত হয়। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গমাতার অবদানের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।
ইউনেস্কো-এর মেমোরি অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে বাছাই উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য শ্রীমতি ডমিনিক সেন্টভিলে যে সকল মানদন্ডের ভিত্তিতে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় তাঁর বিশদ ব্যাখ্যা তুলে ধরেন এবং এ ভাষণের জাতীয় ও আঞ্চলিক গুরুত্বের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গুরুত্ব তুলে ধরেন।
একইসাথে ভাষণের গঠন, নান্দনিকতা, মানবীয় প্রকাশ এবং বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী ক্ষমতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ভাষণটিকে পাবলিক স্পিচ আর্ট এক্সিলেন্সের একটি মডেল হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি ১৯৪০ সালের জেনারেল দ্যা গল এঁর ‘১৯৪০ সালের ১৮ জুনের আপিল’ এর কথা উল্লেখ করেন যা ২০০৫ সালে মেমোরি অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়।
পরিশেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে ওয়েবিনারে সংযুক্ত অংশগ্রহণকারীদের উত্থাপিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর আলোচকবৃন্দ প্রদান করেন। বক্তাগণ ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের তাৎপর্য, বৈশ্বিকতা ও প্রাসংগিকতা নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন।
যেহেতু ৭ই মার্চের ভাষণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চিত মানুষের কথা বলে সে বঞ্চনা এখনো সারা বিশ্বে বিদ্যমান। তাই এ ভাষণের প্রাসংগিকতা পঞ্চাশ বছরেও কমেনি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুর শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি আস্থা, মুক্তি সংগ্রামে অনুসরণীয় ভাষণ হিসেবে পরিগণিত। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও তাঁর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের আবেদন চিরঅম্লান থাকবে।
দীর্ঘ দুই ঘণ্টা ব্যাপি আয়োজিত এ ওয়েবিনারে ইউনেস্কোতে বিভিন্ন দেশের স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তাবৃন্দ, ইউনেস্কো-এর কর্মকর্তাবৃন্দ এবং প্রবাসী বাংলাদেশিগণ অংশগ্রহণ করেন।