প্রকাশ: ১৮ জুন, ২০২২ ০৬:৩৩ পূর্বাহ্ন
 
            
নিজস্ব প্রতিবেদক: উজানের পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারী বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যায় সিলেট ও মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৫০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। গতকাল শনিবার বন্যার ত্রাণ কার্যক্রম নিয়ে সমন্বয় সভায় সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন এ তথ্য জানিয়েছেন বন্যাকবলিত অঞ্চল থেকে দুর্গতদের দ্রত উদ্ধার করা যায় বা জরুরি ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানো যায় সেজন্য প্রশাসনের তরফ থেকে সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য করা হচ্ছে। উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি গতকাল শনিবার থেকে নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী ও কোস্টগার্ড যুক্ত হয়েছে।
জানা গেছে, সুরমা নদীর পর কুশিয়ারা নদীর পানিও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়ে সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। অন্যদিকে বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। একই সঙ্গে টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত রয়েছে।
এ ছাড়াও সিলেট রেল স্টেশনে বন্যার পানি উঠে যাওয়ায় সিলেট থেকে সারাদেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল দুপুরের পর থেকে ঢাকা বা চট্টগ্রাম থেকে ট্রেন চলবে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাও স্টেশন পর্যন্ত। এর আগে সিলেটের আন্ত:জেলা বাস টার্মিনালও বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। তাই সিলেটের সঙ্গে বাস যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে সিলেট এবং সুনামগঞ্জ জেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ায় এ দুই জেলা সেনা মোতায়ন করা হয়েছে। সিলেট জেলা-সিলেট সদও, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ। এছাড়া সুনামগঞ্জ জেলা-সুনামগঞ্জ সদও, জামালগঞ্জ, দিরাই, দোয়ারাবাজার ও ছাতক। এছাড়াও, সুনামগঞ্জের খাদ্য গোডাউন রক্ষা এবং সিলেটের কুমারগাঁও পাওয়ার স্টেশনে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। সেনা সদস্যরা যেসব কাজ করছেন তা হলো - পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নেয়া। বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র নির্বাচন এবং উদ্ধারকৃত ব্যক্তিবর্গের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা। চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা। খাদ্য গোডাউন, পাওয়ার স্টেশন এবং অন্যান্য স্থাপনা রক্ষায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করা। সীমিত পরিসরে খাদ্য এবং সুপেয় পানি সরবরাহ করা।
অপরদিকে সিলেট ও সুনামগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য টোল ফ্রি নম্বর চালু করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এসব টোল ফ্রি নম্বরে যোগাযোগ করে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে পারবেন। এসব নম্বরে বিনামূল্যে ফোন দিয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। টোল ফ্রি নম্বরগুলো হচ্ছে- ০১৭৬৯১৭৭২৬৬, ০১৭৬৯১৭৭২৬৭, ০১৭৬৯১৭৭২৬৮, ০১৮৫২৭৮৮০০০, ০১৮৫২৭৯৮৮০০, ০১৮৫২৮০৪৪৭৭, ০১৯৮৭৭৮১১৪৪, ০১৯৯৩৭৮১১৪৪, ০১৯৯৫৭৮১১৪৪, ০১৫১৩৯১৮০৯৬, ০১৫১৩৯১৮০৯৭, ০১৫১৩৯১৮০৯৮। গতকাল শনিবার আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের বন্যা পরিস্থিতি আরও দু-তিন দিন ধরে অবনতি হতে পারে। উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতিরও দ্রæত অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ, উজানে ভারী বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও বৃষ্টি চলছে। এ অবস্থায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তার জন্য টোল ফ্রি নম্বর চালু করেছে বাংলাদেশ সেনবাহিনী। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় মানবিক সাহায্যে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন এ বিষয়ে সিলেট বিভাগীয় অফিসকে বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করার পর থেকে মানবিক সাহায্যের এই কার্যক্রম আরো জোরদার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকায় খোলা হয়েছে বন্যায় উদ্ধারকাজের মনিটরিং সেল। জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলায় সিলেটের সকল ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে সকলকে স্ট্যান্ডবাই ডিউটিতে মোতায়েন রাখা হয়েছে।

বিপর্যয়ের মুখে থাকা সিলেট সদরের খাদ্য গুদামে ঢুকে পড়া পানি নিয়মিতভাবে ফায়ার পাম্পের মাধ্যমে সেচের কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট। এছাড়া বিপর্যয়ের মুখে থাকা কুমারগাঁও বিদ্যুৎ কেন্দ্রেও নিয়োজিত করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট। সেখানেও তারা ভেতরে ঢুকে পড়া পানি নিয়মিতভাবে সেচ করার মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক ও চলমান রাখার কাজে সহায়তা করছে। ইতিমধ্যে সিলেটের দোয়ারাবাজার ফায়ার স্টেশনে ৪০ জন আশ্রয়হীনকে আশ্রয় প্রদান করা হয়েছে। তাদেরসহ বিভিন্ন স্থানে খাদ্য সাহায্য পৌঁছে দিতেও কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন জানান, ‘ফায়ার সার্ভিস হচ্ছে মানুষের দু:সময়ে বন্ধু। সিলেটের এই মানবিক বিপর্যয়ে আমাদের সদস্যরা ঘরে বসে থাকতে পারেন না। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা সিলেটের বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে আছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই সময় ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের সকল কার্যক্রম নিয়মিত ও নিবিড়ভাবে আমি নিজেও পর্যবেক্ষণ করছি। প্রয়োজনীয় সকল সহায্য নিয়ে এই দুর্যোগে সিলেটবাসীর পাশে থাকবে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা।’
এদিকে পাউবোর দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সুরমা নদী সিলেট (নগরী) পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদী কানাইঘাট পয়েন্টে ৯৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারা নদী শেওলা পয়েন্টে বিপদসীমার ওপরে ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শেরপুর ও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে কুশিয়ারা এবং অমলসিদ পয়েন্টে সুরমার পানি বাড়ছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ জানান, পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় নদ-নদীর পানিও বাড়ছে। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। সিলেটে আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, শনিবার সকাল থেকে দুপুর অবধি ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে ১০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী চলমান বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় পরিস্থিতি আরও নাজুক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পূর্বাভাস অনুযায়ী অন্তত আরও দুদিন বৃষ্টিপাত হবে। একই সময়ে উজানেও ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এতে নদ-নদীর পানি বাড়বে।