ঢাকা, বুধবার, ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৭ ফাল্গুন ১৪৩২, ২১ জ্বমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট: দলগুলো সিদ্ধান্ত মেনে নেবে আত্মবিশ্বাসী সরকার


প্রকাশ: ১১ নভেম্বর, ২০২৫ ০১:৩১ পূর্বাহ্ন


সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট: দলগুলো সিদ্ধান্ত মেনে নেবে আত্মবিশ্বাসী সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক: জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং গণভোটের সময় নিয়ে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে, তা রাজনৈতিক দলগুলো মেনে নেবে বলে মনে করছে অন্তর্বর্তী সরকার। দলগুলোর ভাষণে যতই উত্তেজনা তৈরি হোক, নির্বাচনের স্বার্থে সরকারের সিদ্ধান্ত মানা ছাড়া তাদের পথ নেই। তবে সরকার এমন সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে কোনো দলের প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ আসে। বরং বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির অবস্থানকে সমন্বয় করা হবে।

একাধিক উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা সমকালকে এসব তথ্য ও মূল্যায়ন জানিয়েছেন। যদিও গতকাল সোমবার বিএনপি বলেছে, ঐকমত্যের চ্যাপ্টার ক্লোজড (শেষ)। আগামী সংসদ কী করবে, এই সিদ্ধান্ত সরকার, ঐকমত্য কমিশন বা কোনো দল দিতে পারে না।

জামায়াতসহ আট দল আন্দোলনের হুমকি দিয়ে রেখেছে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং নির্বাচনের আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে। তবে জামায়াত সূত্র বলছে, নির্বাচনের আগে রাজপথে শক্তিমত্তা প্রদর্শনই মূল লক্ষ্য। 

জুলাই সনদ এবং গণভোটের সময়ের বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে– এই প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সমকালকে বলেছেন, শিগগির তা জানানো হবে। সরকার কী সিদ্ধান্ত নেবে, তা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

সরকার আত্মবিশ্বাসী
একাধিক উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সূত্রগুলো সমকালকে বলেছেন, বাইরে উত্তেজনা থাকলেও সরকার উদ্বিগ্ন নয়। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনে সবরকম প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর নির্বাচনের স্বার্থেই বিএনপি সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। তারা সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে নির্বাচনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে না। বিএনপি যে কোনো মূল্যে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন চায়। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত তাদের দলীয় অবস্থানের কাছাকছি না হলেও তারা মেনে নেবে।

জামায়াতের সঙ্গে কথা বলে উপদেষ্টারা একই আভাস পেয়েছেন। একজন উপদেষ্টা সমকালকে বলেন, জামায়াতও ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন চায়। তারা মনে করছে, এবার তাদের ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। তাই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হোক, তা তারা চায় না। তবে জামায়াত জুলাই সনদ অনুযায়ী পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতি বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা চায়। তা করতে পারলে জামায়াত নির্বাচনের দিনে গণভোট আয়োজনে বিরোধিতা করবে না।

বিএনপি গণভোটে রাজি হলেও দলটির স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্য এতে রাজি ছিলেন না। এ সূত্রটির ভাষ্য, ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে বিএনপিকে প্রতিনিধিত্ব করা নেতারা দলীয় ফোরামে আলোচনা ছাড়াই জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোটে রাজি হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে শীর্ষ নেতৃত্বকে তারা গণভোটে রাজি করান। কিন্তু স্থায়ী কমিটির অন্য সদস্যদের আগে থেকে না জানানোর কারণে গণভোটের বিষয়ে এই নেতাদের আপত্তি রয়েছে। তাদের কেউ নির্বাচনের দিনে গণভোট, আবার কেউ কেউ সংবিধানে নেই যুক্তিতে গণভোট আয়োজনের বিরোধিতা করছেন।

সরকারও বিএনপির অভ্যন্তরীণ এ সমস্যার বিষয়ে অবহিত– এমন মন্তব্য করে একাধিক উপদেষ্টা সমকালকে বলেছেন, নির্বাচনের দিনে গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে দলটিকে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন পদ্ধতিতে রাজি করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। 

প্রধান উপদেষ্টা নিজেই অনুরোধ করেছেন। তিনিও সংবিধানের সুরক্ষা এবং টেকসই সংস্কারের জন্য উচ্চকক্ষে পিআর চান। বিএনপি এতে রাজি না হলেও সরকার অন্তত উচ্চকক্ষে পিআরের কাজটি করে যেতে চায়। নির্বাচন নিশ্চিত রাখতে বিএনপি এখন এর বিরোধিতা করতে পারবে না বলে মনে করছেন উপদেষ্টারা।

তাদের মূল্যায়ন, বিএনপি শেষ পর্যন্ত মেনে নেবে। তবে দলটি আগামী সংসদে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় উচ্চকক্ষে পিআর বাদও দিতে পারবে– এমন একটি পথ রাখা হতে পারে, যাতে বিএনপি সংস্কার চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলতে না পারে।

সমঝোতা হবে না জেনেও সময় দেওয়া
গত ৩ নভেম্বর উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠকে সরকার রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে আলোচনায় বসে এক সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানাতে আহ্বান জানায়। গতকাল এই সময়সীমা শেষ হয়েছে। জামায়াত আহ্বান জানালেও বিএনপি আলোচনায় সাড়া দেয়নি। দলটি বলেছে, শুধু সরকার ডাকলে আলোচনায় যাবে। সরকার জানিয়েছে, ঐকমত্য কমিশনে ৯ মাসের সংলাপের পর তারা আর আলোচনা আয়োজন করতে আগ্রহী নয়।

একাধিক উপদেষ্টা সমকালকে বলেছেন, দলগুলোর মধ্যে যে সমঝোতা হবে না, তা অনুমেয় ছিল। সরকার চাইলে ৩ নভেম্বরই আদেশ জারির সিদ্ধান্ত দিতে পারত। আদেশ মনঃপূত না হলে তখন সরকারের ওপর চাপ তৈরি করত বিভিন্ন দল। এ কারণে দলগুলোকে সময় দেওয়া হয়েছে সমঝোতার জন্য। তারা যে সমঝোতা করতে পারেনি, তা জনগণের সামনে স্পষ্ট হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার বাধ্য হয়েই নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত দিয়েছে– এখন মানুষের কাছে এমন বার্তা যাবে।
উপদেষ্টা জানান, আদেশ চূড়ান্তকরণের কাজ চলছে। সরকার দ্বিতীয় খসড়া গ্রহণ করতে পারে। ২৭০ দিনের সংস্কারের বাধ্যবাধকতা থাকবে না। আর কিছু ছাড় থাকবে বিএনপির দাবিতে। তবে অন্য দলগুলোকে সন্তুষ্ট করতে এবারের নির্বাচন থেকে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনের বিধান রাখা হতে পারে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধান উপদেষ্টা।

সরকার ও দলগুলো যা বলছে
রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে মতৈক্যে পৌঁছাতে না পারায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার নিজ থেকেই সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান। তিনি সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, কাউকে বলতে শুনিনি যে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। গণঅভ্যুত্থানে গঠিত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার রয়েছে। সরকার চায় ১০০ ভাগ সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভেতর দিয়ে আসুক। যদি ৯০ ভাগও আসে, ১০ ভাগ না আসে, সে ক্ষেত্রে অচলাবস্থা দূর করতে সরকারের নিজস্ব দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে।


   আরও সংবাদ