প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর, ২০২৫ ১১:৫৬ পূর্বাহ্ন
 
            
নিজস্ব প্রতিবেদক: বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে পদসৃজন, পদবিলুপ্ত, গাড়ির আবদার ও তদন্তকেন্দ্রসহ প্রায় এক ডজন চাওয়া–পাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আজ সোমবার। এ বিষয়ে একটি সভার আয়োজন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
পুলিশ বাহিনীর মঞ্জুরিকৃত কনেস্টবল পদ থেকে চার হাজার কনেস্টবল পদ বিলুপ্তের সুপারিশ করেছে অধিদপ্তর। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সভায় সিদ্ধান্তের পর কার্যকরে যাবে বাহিনী/অধিদপ্তর। যেখানে বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশের সদস্য সংখ্যা কম। সেখানে সদস্য সংখ্যা কমিয়ে নিয়ে আসা কতটা যৌক্তিক সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে বাহিনীর মধ্যে।
পুলিশের ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, এএসআই পদ সৃজন করে কনেস্টবল পদ বিলুপ্তের সিদ্ধান্তে প্রকৃতভাবে পুলিশের কার্যক্ষমতা বাড়ছে না, আরও কমছে। একজন কনেস্টবলের কাজ এএসআইকে দিয়ে করানো যাবে না। পোট্রোল ও টহল ডিউটিতে ঝামেলা সৃষ্টি হবে। একজন কনেস্টবল যখন পদোন্নতি পেয়ে এএসআই হয়, তখন তার কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিপায়। এখন সেটা হবে না। যদি সরকার কনেস্টবল ঠিক রেখে এএসআই নিয়োগ করত, সেক্ষেত্রে বাহিনীর সক্ষমতা প্রকৃতভাবে বৃদ্ধি পেত।
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে মঞ্জুরিকৃত কনেস্টবল পদ রয়েছে এক লাখ ৩০ হাজার ৩০৮টি। এর মধ্যে এক লাখ ১০ হাজার ২৬১ জন পুরুষ এবং ১৩ হাজার ৮৫০ জন নারী কনস্টেবল কর্মরত রয়েছেন। মঞ্জুরিকৃত পদের সঙ্গে কর্মরত জনবলের ঘাটতি রয়েছে ৬ হাজার ১৯৭জন। বাহিনীতে মঞ্জুরিকৃত এই কনেস্টবল পদ থেকে চার হাজার পদ বিলুপ্তের সুপারিশ করেছে পুলিশ অধিদপ্তর।
গত ২০ অক্টোবর সভার আয়োজন করে একটি নোটিশ জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে সই করেন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আবু সাঈদ। নোটিশে বলা হয়, মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির সভাপতিত্ব করবেন। বিষয়টি পুলিশ মহাপরিদর্শক, অতিরিক্ত সচিব, পুলিশ শাখার যুগ্ম সচিব, উপসচিব ও সহকারী সচিব পদমর্যাদার সাত কর্মকর্তাকে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি চিঠিতে দেখা গেছে, পুলিশ অধিদপ্তর থেকে বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে পদসৃজন, পদ বিলুপ্তকরণ, ফাঁড়ি–তদন্তকেন্দ্র স্থাপন এবং যানবাহন–সরঞ্জামাদি টিওঅ্যান্ডই ভুক্তকরণ সংক্রান্ত প্রস্তাব পর্যালোচনার মাধ্যমে কার্যকারের বিষয়ে সভার আয়োজন করেছে মন্ত্রণালয়। আজ সোমবার বেলা ১২টায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে এই পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের বরাবরই গাড়ির একটা সংকট ছিল। এর মধ্যে জুলাই গণঅভূত্থানের সময় একাধিক গাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সব মিলিয়ে বাহিনীতে গাড়ির সংকট চরমে। সব দিকে বিবেচনা করে পর্যায়ক্রমে বেশ কিছু গাড়ি পেয়েছে পুলিশ। নির্বাচনের আগে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ (সিএমপি) ২ হাজার ৮৮০টি এবং সিআইডি ৭৬০টিসহ বিভিন্ন ইউনিটের ৪৫০৩টি গাড়ি আবদার করেছে।
সিআইডির এক ঊদ্ধর্তন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিআইডিতে একটি গাড়ি একাধিক কর্মকর্তা ব্যবহার করেন। যেখানে পুলিশের অন্যান্য ইউনিটে এসপি পদমর্যদার কর্মকর্তারা একটি জিপ ব্যবহার করেন, সেখানে সিআইডিতে একটি জিপ একাধিক কর্মকর্তা ব্যবহার করেন। এই গাড়ির সংকটের বিষয়টি জানিয়ে সদরদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর কোনো সিদ্ধান্ত জানা যায়নি।
সিএমপির উপকমিশনার (সদরদপ্তর) মুহাম্মদ ফয়সাল আহম্মেদ সমকালকে বলেন, সিএমপিতে গাড়ির সংকট খুব বেশি। যে পরিমান থাকার কথা সেই পরিমান নেই। এদিকে সামনে নির্বাচনের আগে গাড়ির সংকট দূর করতে সদরদপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। জুলাই গণঅভূত্থানে অনেক গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে সিএমপির ২৮৩টি গাড়ি আছে। ২৮৮০টি গাড়ির প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
পুলিশের এক ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশের টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ি থাকার কথা ৬১৬০টি। সেটা বাহিনীতে নেই। এর মধ্যে গত মার্চে আরও ১৩৮৫টি গাড়ি অকেজো ঘোষণা করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর আগে জুলাই আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১০২৪টি গাড়ি। তার মধ্যে ৫২৬টি গাড়ি ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ৪১৮টি গাড়ি সরকার বিভিন্ন সময় কিনে দিয়েছে। সেখানেও ১০৮টি গাড়ি কম। সব মিলিয়ে বাহিনীতে গাড়ির চরম সংকট যাচ্ছে। নির্বাচনের আগে গাড়ির সংকট কমিয়ে আনা না গেলে ডিউটি পালনে বেঘাত ঘটতে পারে।
এতে পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত বিভিন্ন ইউনিট থেকে ৪ হাজার কনস্টেবল পদ বিলুপ্তের বিষয়টি আজ সোমবার মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে পুলিশ অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামোতে ১৮টি ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (গ্রেড-১০)পদ; পুলিশ অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামোতে ১১২টি; পুলিশ ইন্টারনাল ওভারসাইটের (পিআইএ) সাংগঠনিক কাঠামো সংস্কারে ৯৩২টি পদ, ৮৩০টি যানবাহন এবং ৬হাজার ৫০৬টি সরঞ্জামাদি টেবিল অফ অর্গানিজশন এন্ড ইকুইপমেন্ট (টিওএন্ডই) ভুক্তকরণ; সিআইডির সাংগঠনিক কাঠামো সংস্কারে ২ হাজার ৭৯৪টি পদ ও ৭৬০টি যানবাহন; সিএমপির টিওএন্ডই-তে ২ হাজার ৮৮০টি যানবাহন অন্তর্ভুক্তি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
এ ছাড়া নেত্রকোণার কেন্দুয়া থানাধীন ‘রামপুর বাজার পুলিশ তদন্তকেন্দ্র’ স্থাপন এবং পরিচালনার জন্য ২৭টি পদ সৃজন, ৬টি যানবাহন ও একটি টিওএন্ডই; মেহেরপুরের গাংনী থানাধীন ‘কসবা পুলিশ তদন্তকেন্দ্র’ স্থাপন এবং পরিচালনার জন্য ২২টি পদ, ৭টি যানবাহন টিওঅ্যান্ডই; গাংনী থানাধীন ‘হিন্দা পুলিশ তদন্তকেন্দ্র’ স্থাপন এবং ২২টি পদ, ৭টি যানবাহন টিওঅ্যান্ডই এবং নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানাকে বিভক্ত করে ‘রায়পুরা চরাঞ্চল’ থানা স্থাপন এবং পরিচালনার জন্য ১১৬টি পদ সৃজনসহ ১৩টি যানবাহন টিওঅ্যান্ডইভুক্তকরণ করার সুপারিশ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে।
নরসিংদীর এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, রায়পুরা থেকে থেকে ফোর্স গিয়ে চরাঞ্চলে অপরাধ দমনে হিমশিম খেতে হয়। এ ছাড়া ওই এলাকায় মারামারি থেকে শুরু করে মাদক চোরা কারবারিদের অভয়রণ্য হয়ে উঠেছে। একটি ফাঁড়ি দিয়ে এসব অপরাধ দমন করা সম্ভব হচ্ছে। সব দিক বিবেচনা করে থানার প্রস্তাব করা হয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশের মঞ্জুরিকৃত ডিআইজি পদ ৮৭টি। বর্তমানে কর্মরত আছে ১১৭ জন। মঞ্জুরি পদের চেয়ে ৩০জন কর্মকর্তা বেশি। এর মধ্যে ৬৫ জন সুপারনিউমারারী পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত। পুলিশের মঞ্জুরিকৃত অতিরিক্ত ডিআইজি পদ ২০১টি। বর্তমানে কর্মরত আছে ৩৩৯ জন। মঞ্জুরি পদের চেয়ে ১৩৮জন কর্মকর্তা বেশি। এর মধ্যে ১৪০ জন সুপারনিউমারারী পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত। পুলিশের মঞ্জুরিকৃত পুলিশ সুপার (এসপি) পদ ৫৯৬টি। বর্তমানে কর্মরত আছে ৭৪৬ জন। মঞ্জুরি পদের চেয়ে ১৫০জন কর্মকর্তা বেশি। এর মধ্যে ১৫০ জন সুপারনিউমারারী পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত। পুলিশের মঞ্জুরিকৃত অতিরিক্ত এসপি পদ ১০০৮টি। বর্তমানে কর্মরত আছে ৯৬১ জন। মঞ্জুরি পদের চেয়ে ৪৭জন কর্মকর্তা কম এবং পুলিশের মঞ্জুরিকৃত এএসপি পদ ১২৩১টি। বর্তমানে কর্মরত আছে ৮৯৯ জন। মঞ্জুরি পদের চেয়ে ৩৩২জন কর্মকর্তা কম। বর্তমানে পুলিশে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থেকে কনেস্টবল পর্যন্ত ৯হাজার ৮৮০টি পদ খালি রয়েছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের মুখপাত্র এআইজি এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন সমকালকে বলেন, চার হাজার কনেস্টবল পদ বিলুপ্তে বাহিনীর সংখ্যায় তেমন পরিবর্তন আসবে না। কারণ সহকারী পুলিশ পরির্দশক (এএসআই) পদ চার হাজার সৃজন করা হয়েছে। তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া প্রতি বছর পুলিশের কিছু গাড়ি বাতিল ঘোষণা করা হয়। আবার নতুন গাড়ি কেনা হয়। এটা চলমান প্রক্রিয়া। তবে পুলিশের টিওঅ্যান্ডইভুক্ত গাড়ি যা থাকার কথা, সেটাও কম আছে।