ঢাকা, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩২, ২৪ জ্বমাদিউল আউয়াল ১৪৪৭

৩ মাসে চারবার শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে হত্যাচেষ্টা

পুরান ঢাকায় প্রকাশ্যে খুন

প্রকাশ: ১২ নভেম্বর, ২০২৫ ০৮:১৩ পূর্বাহ্ন


৩ মাসে চারবার শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে হত্যাচেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক: পুরান ঢাকায় ফিল্মি স্টাইলে খুন হওয়ার আগেও অন্তত ৩বার টার্গেটে পরিণত হয় নিহত শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাইফ মামুন। গত তিনমাস আগে নতুন করে তাকে হত্যার মিশন হাতে নেয় ইমন গ্রুপ। এরপর রাজধানীর মিরপুর-১১নম্বর, ধানমন্ডি ও ঝিগাতলায় আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীদের নিশানা হয়েও প্রাণে বেঁচে যান মামুন। কিন্তু চতুর্থ বার মামুনের আদালতে হাজিরা দেওয়ার খবর পেয়ে কিলিং মিশন সফল করেন সন্ত্রাসীরা।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, প্রথম ৩টি ঘটনার নেতৃত্ব দেন ফারুক হোসেন ফয়সাল। ওইসব ঘটনায় উপস্থিত ছিলেন না শ্যুটার রবিন আহম্মেদ ওরফে পিয়াস। তবে হত্যাকাণ্ডের দিন আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের ঘনিষ্ট সহচর মিরপুর এলাকার সন্ত্রাসী রনির নির্দেশে মিজানের সঙ্গে যোগ দেয় শ্যুটার রবিন। ঘটনাস্থল থেকে পুরো ঘটনার নেতৃত্ব দেন তিনি রনি নিজেই।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে অপরাধজগতের সব শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে আসে। এরপরই শুরু হয় অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণের নতুন সমিকরণ। দেশের বাইরে থাকা ক্যাপ্টেন ইমনের ধানমন্ডি ও মোহাম্মদপুরসহ পুরো এলাকার রাজত্ব মামুনের কব্জায় চলে যাওয়ার আশঙ্খা থেকে খুনের সিদ্ধান্ত চুড়ান্ত করেন ইমন। এতে তার গ্রুপের লিডার সন্ত্রাসী মুদিদোকানী রনি কিলিং মিশনের পরিকল্পনা ঠিক করেন। আগের তিনটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ণ না হওয়ায় চাপ বাড়ছিল রনির ওপর।

এদিকে মামুনেরও এসব এলাকায় যাত্রায়াত বেড়ে যাওয়ায় চিন্তিত ছিল ইমন ও রনি। সর্বশেষ আদালত পাড়াকে বেঁচে নিয়ে রনি নিজেই শার্পশ্যুটার কুত্তা ফারুক ও রবিনকে সঙ্গে নিয়ে কিলিং মিশনের নেতৃত্বে দেন। এদিকে মামুনের মৃত্যুর পর বিদেশ থেকে রাজত্ব নিয়ন্ত্রণ করা জিসান আহমেদ তার অরক্ষিত মতিঝিল এলাকা নিয়ে সক্রিয় হচ্ছে কয়েকটি গ্রুপ। এতে অপরাধজগতের নতুন সমিকরণ নিয়ে দ্বন্দ্বে আরও খুনের শঙ্কা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।

আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের ৩২ ঘণ্টার মধ্যে দুই শ্যুাটার ফারুক ও রবিনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। জানা যায়, মিশনে সহযোগি হিসেবে ঘটনাস্থলে মোটারসাইকেল নিয়ে ছিলেন বাইকার শামীম আহম্মেদ, সুমন ও কিলার কালাম। মিশন শেষ হওয়ার পর রনির নির্দেশে ম্যানেজার রুবেল তাদের নিয়ে সিলেট সীমান্তে চলে যান। সেখানে তাদের দুই লাখ টাকা দেন। পরে সবার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেন। যাতে তাদের গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হয়।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট সূত্রটি বলছে, হত্যার পরিকল্পনাকারী রনি নিহত মামুনেরও একসময় ঘনিষ্ট ছিল। তারা দুজনই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের হয়ে কাজ করতেন। কিন্তু মামুনের প্রথম স্ত্রী স্বপ্নার সঙ্গে ইমনের অবৈধ সম্পর্কের গুঞ্জন এবং ইমনের কারণে পাঁচ মামলায় জামিন পেয়েও কারাগার থেকে বের হতে না পারার আক্ষেপ থেকে শুরু হওয়া মনোমালিন্যে শেষমেশ প্রকাশ্য শত্রুতায় রূপ নেয়। বন্ধুর সঙ্গে পাংগা নিতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে হাত মেলানোর পরিণতি হিসেবে মামুনকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো। 

ডিবি বলছে, গ্রেপ্তার হওয়া শুটার কুত্তা ফারুকের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও অপহরণসহ পাঁচটি এবং রবিনের বিরুদ্ধে চুরিসহ ২টি মামলা করেছে। তবে শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন কারাগারে থাকার সময় কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া শ্যুটার কুত্তা ফারুক, রবিন ও সুমনের পরিচয় হয়। পরে তারা ইমনের সঙ্গে সখ্য হয়ে ওঠে। ইমন কারাগার থেকে বের হওয়ার পর তাদের সংগঠিত করে। এসময় শ্যুটাররা ইমনের দলে নাম লেখায় তারা। বর্তমানে ইমনের সম্রাজ্য দেখভাল করতে থাকা রনির নির্দেশনা মতো কাজ শুরু করেন।

রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে গতকাল বুধবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) শফিকুল ইসলাম বলেন, আলোচিত মামুন হত্যার ৩২ঘন্টার মধ্যেই দুই শ্যুটার ফারুক ও রবিনসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- দর্জি দোকানি ইউসুফ ওরফে জীবন, রনির ম্যানেজার রুবেল ও বাইকার শামীম আহম্মেদ। মঙ্গলবার রাতে সিলেট সদর ও নরসিংদীর ভেলানগর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পরে রাজধানীর রায়েরবাজার ইউসুফের বাসা থেকে হত্যায় ব্যবহৃত দুইটি পিস্তল, ৬রাউন্ড গুলি ও দুটি ম্যাগাজিন উদ্ধার করা হয়। আর শ্যুটার ফারুক ও রবিনের কাছ থেকে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪০ টাকা উদ্ধার করা হয়। যা তাদের দিয়েছিল রনি।

শফিকুল ইসলাম বলেন, একসময়ের মুদি দোকানি কাফরুলের বাসিন্দা এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী রনি এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। হত্যাকাণ্ডের জন্য রনি শ্যুটারদের অস্ত্রও সরবরাহ করেন। মূলত আন্ডারওয়ার্ল্ডের আধিপত্য বিস্তার নিয়েই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

তিনি বলেন, মামুনের মামলার হাজিরার দিনে কিলিং মিশনের পরিকল্পনা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ৯নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে রনি তার বাসায় রবিনকে ডেকে নেন। রবিনকে জানানো হয়, হত্যাকাণ্ডের সময় ফারুক, সুমন, কিলার কামালসহ আরও কয়েকজন থাকবে। এতে রবিন রাজি হন। ঘটনার দিন গত সোমবার সকালে রনি ফোন দিয়ে সবাইকে আদালত এলাকায় যেতে বলেন। রবিন তার বন্ধু শামীমের মোটরসাইকেলে আদালত এলাকায় এসে হত্যায় অংশ নেন। অন্যরাও সে সময় আদালত এলাকায় অবস্থান করছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে সুমন ও ফারুকের গুলি করার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে ফারুক ও রবিন গুলি করেন। মামুনের গতিবিধি অনুসরণ করে ফারুক ও রবিনকে খবর দেন কামাল। 

মহানগর ডিবিপ্রধান বলেন, বর্তমানে রনি, সুমন ও কামাল পলাতক রয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।

এদিকে গতকাল পর্যন্ত এ ঘটনায় হত্যা মামলা হয়নি। ডিএমপির সূত্রাপুর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেছেন, নিহতের স্ত্রী বিলকিস আক্তার আজ বৃহস্পতিবার মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় করা মামলায় দুই শুটারসহ গ্রেপ্তার ৫ জনের চারদিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত।


   আরও সংবাদ